Episode 4754 words0 views

পর্ব ৩: কলমের শক্তি

আল-কুতুবের রক্ত এবং নহবতখানার সিঁড়ি মুর্শিদাবাদ। অনির্বাণ একদিন পর মালদহ থেকে খেয়া পার হয়ে মুর্শিদাবাদে পৌঁছালেন। তিনি সরাসরি হাজারদুয়ারির কাছে অবস্থিত নহবতখানায় গেলেন। ইতিহাসের এই নীরব সাক্ষী যেন আড়াইশো বছরের পুরোনো চাপা কান্না বহন করছিল। নহবতখানার পাথুরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ আবারও নবাবের চিঠিটি পড়লেন। 'আল-কুতুবের রক্ত'—আল-কুতুব ছিল নবাবী লিপিকর বংশ। তিনি সিঁড়ি গুনতে শুরু করলেন। সিঁড়ির সংখ্যা ছিল অদ্ভুত: দশ, বারো, তারপর একটি বড় পাথরের ধাপ, তারপর আবার সাতটি। তিনি শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কৌটাটি বের করে শেষ সিঁড়ির পাথরের ওপর রাখলেন। ক্যালিগ্রাফির সেই সূক্ষ্ম নকশা, যা দেখতে অনেকটা ফার্সি অক্ষর 'আলিফ' এবং 'লাম'-এর মতো, যেন শেষ সিঁড়ির পাথরের একটি বিশেষ খাঁজের সঙ্গে মিলে গেল। মুহূর্তেই অনির্বাণ একটি চাপা 'ক্লিক' শব্দ শুনলেন। সিঁড়ির শেষ ধাপের পাথরটি সামান্য সরে গেল। ভেতরে একটি ছোট গর্ত। তার মধ্যে একটি পিতলের মশাল এবং একটি চর্মপত্র। চর্মপত্রে লেখা: "আলো নয়, শব্দ—যেখানে ঘুমায় না কেউ, সে পথেই কাসিমের নামা। কলমের নিব যেখানে ছোঁয়া দেবে, সেখানেই মুক্তির ঠিকানা।" 'কলমের নিব' সঙ্কেতটি ছিল নতুন। অনির্বাণ তার সঙ্গে আনা হাতির দাঁতের সেই পুরোনো কলমটি বের করলেন। তিনি ভাবলেন, এই নহবতখানা যখন সক্রিয় ছিল, তখন এর নহবত (বাদ্যযন্ত্র) থেকে নির্গত শব্দই সম্ভবত 'যেখানে ঘুমায় না কেউ' সঙ্কেতটির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তিনি কলমটি হাতে নিয়ে গর্তের ভেতরের দেয়ালে একটি বিন্দুতে আলতো করে ছোঁয়ালেন, যেখানে একটি অস্পষ্ট শিলালিপি খোদাই করা ছিল—নবাবী আমলের একটি বিশেষ ফার্সি কবিতার অংশ। কলম ছোঁয়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই গর্তের ভেতরের মশালটি আপনা-আপনি উল্টো দিকে ঘুরে গেল। সেখানে একটি নতুন, গভীর প্রকোষ্ঠের দরজা উন্মুক্ত হলো। অনির্বাণ দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলেন। গুপ্ত কক্ষ: লিপিকারের ডায়েরি ও গোপন সতর্কবার্তা গুপ্ত প্রকোষ্ঠটি ছিল শীতল, শুষ্ক। ভেতরে একটি পুরোনো কাঠের টেবিল আর একটি স্টেনসিলের মতো দেখতে যন্ত্র। আর সেখানে পাওয়া গেল আল-কুতুব বংশের প্রধান লিপিকর মীর মনসুর-এর ব্যক্তিগত ডায়েরি। ডায়েরির পাতাগুলো ছিল ক্যালিগ্রাফিক অক্ষরে লেখা, যেখানে মীর কাসিমের পতনের শেষ দিনগুলোর বিবরণ ছিল। মীর মনসুরই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নবাবের আদেশ অনুসারে বিশ্বাসঘাতকতার দলিলগুলো এনক্রিপ্ট করেছিলেন। ডায়েরিতে লেখা ছিল: "...নবাব জানতেন, কাগজ পুড়ে ছাই হবে, সোনা চুরি হবে। তাই তিনি 'আমানত'-কে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। প্রথম অংশ—'বিশ্বাসঘাতকতার দলিল'—যা রাজনৈতিক ভিত্তি ভাঙবে। দ্বিতীয় অংশ—'আর্থিক ফর্মুলা'—যা অর্থনৈতিক ভিত্তি ভাঙবে। তৃতীয় অংশ—'গুপ্তচরের রক্ত'—যা ভবিষ্যতের বিপদ থেকে সতর্ক করবে। প্রথমটি সুরক্ষিত আছে মুর্শিদাবাদে। দ্বিতীয়টি নিয়ে মোবারক যাবে দূরে, যেখানে সূর্যের তেজ অস্ত যায় না (অর্থাৎ ঢাকা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাবের বিপরীতে)..." ডায়েরির একটি পাতায় ছিল একটি আঁকা চিত্র—কাত্রা মসজিদের একটি অংশের নকশা। সেই নকশায় পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে, মসজিদের কোন মিনারটি শব্দ সঙ্কেতটির সঙ্গে যুক্ত। অনির্বাণ ডায়েরি এবং নকশাটি নিলেন। তিনি জানতেন, এই ডায়েরিই প্রমাণ করে যে নবাবের আমানত দুই ভাগে বিভক্ত। তাকে কেবল একটি অংশ খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল ডায়েরির শেষ পাতায়। সেখানে ছিল একটি সূক্ষ্ম ক্যালিগ্রাফিক পঙ্ক্তি, যা সহজে চোখে পড়ে না। অনির্বাণ কৌটার 'রক্তের পথ' নকশার সঙ্গে ক্যালিগ্রাফিটি মেলাতেই একটি গোপন সতর্কবার্তা ভেসে উঠল, যা মীর মনসুর লিখেছিলেন: "যেই রক্তে বিশ্বাসঘাতকতার বিষ, তার ছায়া যেন তোমার পথে না পড়ে। রক্ত কখনও রং পাল্টায় না। যে তোমার পথ দেখাবে, সে হয়তো তোমার দিকে ছুরিও তাক করতে পারে। আল-কুতুবের শেষ সতর্কতা: পথনির্দেশক বন্ধু নাও হতে পারে।" অনির্বাণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। 'পথনির্দেশক' কি সেই ইরা? যে তাকে খুঁজছে এবং একই সঙ্গে তার গতিপথ অনুমান করতে সক্ষম? এই সন্দেহ অনির্বাণের মনকে বিষিয়ে তুলল। তিনি বুঝলেন, তার লড়াই কেবল রণজিতের সঙ্গে নয়, তার সঙ্গেও—যে ছায়ার মতো তার পিছনে লেগে আছে এবং যার আসল উদ্দেশ্য এখনও অজানা। অনির্বাণ কৌটাটি তার বুকের কাছে চেপে ধরলেন। বিশ্বাসঘাতকতার রক্ত—এই শব্দগুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগল। ইরার কৌশল: নজরদারি এবং সন্দেহের জাল মুর্শিদাবাদে পা দিয়েই ইরা বুঝতে পারল, অনির্বাণ নহবতখানায় এসেছেন। তার পাঠানো একটি ক্ষুদ্র ড্রোন নহবতখানার কাছে একটি তাপের উৎস শনাক্ত করেছিল। ইরা দ্রুত রণজিৎকে মিথ্যা রিপোর্ট দিল: "নহবতখানায় কোনো সঙ্কেত নেই। অনির্বাণ রায় সম্ভবত ভুল পথে গিয়েছেন। আমাদের উচিত মুঙ্গেরের দিকে মনোযোগ দেওয়া। নবাবের শেষ ঘাঁটি সেখানেই ছিল।" কিন্তু জামাইল এবার ইরার কথায় সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করল না। সে একটি ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিল। নহবতখানা থেকে অনির্বাণ যখন বেরিয়ে আসছেন, তখন তিনি দেখলেন, এক বৃদ্ধ ফকির তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফকিরটি হঠাৎ অনির্বাণের দিকে এগিয়ে এসে আল-কুতুবের কৌটার দিকে ইশারা করে ফিসফিস করে বলল, "রক্তের পথ—এটা ভুল হাতে নেই তো? নবাবের আমানত লোভীর হাতে পড়লে, বংশের অভিশাপ তোমাকেও গ্রাস করবে।" অনির্বাণ চমকে উঠলেন। এই ফকির কোথা থেকে এল? তার চোখ ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। অনির্বাণ দ্রুত ফকিরকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জামাইলের লোক তাকে জোর করে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। ফকিরটি ছিল জামাইলের নিজস্ব গুপ্তচর। এই ঘটনা ইরার জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা ছিল। জামাইল এই ফকিরকে ব্যবহার করেছিল এই পরীক্ষা করার জন্য যে, ইরা কি সত্যিই অনির্বাণকে পালাতে সাহায্য করছে, নাকি সে কেবল মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছে। ইরার মিথ্যা রিপোর্ট সত্ত্বেও জামাইল বুঝতে পারল, অনির্বাণ মুঙ্গেরের দিকেই যাচ্ছে, কিন্তু ইরার উদ্দেশ্য এখনও অস্পষ্ট। জামাইল এবার ইরাকে অন্ধকারে রেখে মুঙ্গেরের দিকে নিজস্ব দল পাঠাল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion