Episode 5562 words0 views

পর্ব ৪: যমুনার তীরে বিশ্বাসঘাতকতা

কাত্রা মসজিদের প্রতিধ্বনি ও তৃতীয় আমানত অনির্বাণ রায় কাত্রা মসজিদের সামনে পৌঁছালেন। বিশাল সমাধিস্থল। সঙ্কেত ছিল: "আলো নয়, শব্দ—যেখানে ঘুমায় না কেউ..." তিনি মিনারের দিকে দৌঁড়ালেন। মিনারের প্রবেশপথ তালাবন্ধ। কিন্তু অনির্বাণ দেখলেন, ফটকের ঠিক উপরে, একটি পুরোনো ঝাড়বাতির হুকের নিচে, একটি সুড়ঙ্গের মতো ফাটল। তিনি সেই ফাটলের কাছে পৌঁছালেন এবং আল-কুতুবের কৌটাটি ব্যবহার করে জোরে ফিসফিস করে কিছু বললেন। "আল্লাহু আকবার!" শব্দটি মসজিদের স্থাপত্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একটি অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করল। সেই কম্পনের ফলে মিনারের পাশে রাখা একটি প্রাচীন সিন্দুকের ঢাকনা সামান্য সরে গেল। ভেতরে ছিল একটি মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির ভেতরে ছিল একটি অসম্পূর্ণ মানচিত্র এবং একটি ক্ষুদ্র হাতির দাঁতের খন্ড। মানচিত্রটি বাংলার কিছু নদীর গতিপথ দেখাচ্ছে, যা শেষ হয়েছে মুঙ্গেরে গিয়ে—ঠিক যেখানে মীর কাসিম তার শেষ সামরিক ঘাঁটি গেড়েছিলেন। মানচিত্রের শেষ বিন্দুতে ফার্সি অক্ষরে লেখা—"শেষ ঘাট: অভিশাপ ও আমানত।" হাতির দাঁতের খন্ডটি ছিল তৃতীয় আমানত। এটি ছিল একটি ক্ষুদ্র সাউন্ড রেকর্ডিং ডিভাইস, যা আল-কুতুব বংশের শব্দ-শোষণকারী প্রযুক্তিতে তৈরি। এটিতে ছিল মীর কাসিমের কন্ঠস্বর—যেখানে তিনি বিশ্বাসঘাতক জমিদারদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। অনির্বাণ হাঁড়িটি নিয়ে আবার পালানোর চেষ্টা করতেই ইরা এবং তার সহযোগী জামাইল তাকে ধরে ফেলল। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে হাঁড়িটি ভেঙে গেল। মানচিত্রটি ইরা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু অনির্বাণ সেটি নিয়ে পাশের একটি সংকীর্ণ গলিতে ঝাঁপ মারলেন। এই সময়ে, অনির্বাণ হাতির দাঁতের খন্ডটি আল-কুতুবের কৌটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। মুঙ্গেরের অভিশাপ ও বসের মুখোমুখি: দ্বিতীয় আমানত মুঙ্গের, বিহার। একসময় মীর কাসিমের শক্তিশালী দুর্গ, এখন ভগ্নপ্রায়। অনির্বাণ মুঙ্গেরে পৌঁছালেন। মানচিত্রে চিহ্নিত 'শেষ ঘাট' খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। স্থানীয়রা একে 'অভিশাপের ঘাট' বলত। সেখানেই, শেষ ঘাটের পাশে একটি পুরোনো বটগাছের নিচে, অনির্বাণ খুঁজে পেলেন আল-কুতুব বংশের এক বৃদ্ধ লিপিকরকে। প্রায় ৯৫ বছর বয়সী সেই বৃদ্ধ, নাম মঈনুদ্দিন আল-কুতুব। মঈনুদ্দিন অনির্বাণকে একটি বিশেষ পদ্ধতি দেখালেন। পূর্ণিমার রাতে, ঘাটের নিচে পাথরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নদীর জল যখন পৌঁছায়, তখন একটি বিশেষ শিলালিপি ভেসে ওঠে। তারা দু'জন পূর্ণিমার রাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠিক মধ্যরাতে, জলের স্তর যখন পাথরের খাঁজে পৌঁছাল, তখন শিলালিপিটির কিছু অংশ জ্বলজ্বল করে উঠল। সেটি ছিল একটি দীর্ঘ, ছন্দবদ্ধ কবিতা, যার শেষ দুটি লাইন ছিল: ...নহে এ সোনা, নহে রত্নরাজি, এ সত্যের দাম বেশি। ধন নাই, মান আছে, জাহাঙ্গীরনগর হবে শেষ ঠিকানা, সাত গম্বুজের হাসি। জাহাঙ্গীরনগর—অর্থাৎ আজকের ঢাকা। সঙ্কেতটি স্পষ্ট হলো। নবাবের 'শেষ চাল' ঢাকাতে লুকানো আছে, সাত গম্বুজ মসজিদে। ঠিক সেই সময়, রাতের আঁধার চিরে ঘাটে একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন চালিত গাড়ি এসে থামল। রণজিৎ চৌধুরী তার সঙ্গে ইরা এবং জামাইলসহ আরও পাঁচজন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে উপস্থিত হলেন। "ডক্টর রায়," রণজিতের কণ্ঠস্বর ছিল নিচু এবং শীতল। "আপনার খেলা শেষ। আপনি আমার উদ্দেশ্য পূরণ করেছেন। এবার আমাকে নবাবের আমানত দিন।" রণজিৎ হাসলেন। "আমানত যাই হোক, তা এখন আমার। আমার বংশধররা ছিলেন সেই তিন বিশ্বাসঘাতক জমিদারের অন্যতম, যারা ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। কিন্তু এই দলিলগুলো আমাকে সেই ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেবে। দীর্ঘ আড়াইশো বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা এর জন্য অপেক্ষা করেছেন।" যখন রণজিৎ তার দিকে হাত বাড়ালেন, তখন বৃদ্ধ মঈনুদ্দিন আকস্মিকভাবে তার হাতে থাকা একটি পুরোনো পুঁথি রণজিতের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারলেন। এই সামান্য সময়ের সুযোগে অনির্বাণ নদীর দিকে ঝাঁপ দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে নদীর জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রণজিতের লোকেরা তাকে খুঁজে পেল না। অনির্বাণ স্রোতে ভেসে চললেন, ঢাকা যাওয়ার একমাত্র সঙ্কেত আর আল-কুতুবের কৌটা শক্ত করে ধরে। ইরা হতাশভাবে জলের দিকে তাকিয়ে রইল। জামাইল তাকে ধমক দিল: "এবারও ব্যর্থ! বস এর ফল ভালো হবে না।" ইরা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিল: বস-এর প্রতিশোধের আগুন এবার অনির্বাণকে স্পর্শ করার আগেই তাকে ঢাকা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী? অনির্বাণকে সাহায্য করা, নাকি নবাবের সেই সত্যের দলিল প্রথমে নিজের হাতে পাওয়া? এই দ্বন্দ্ব তাকে অস্থির করে তুলল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion