Episode 6890 words0 views

পর্ব ৫: নদীর বুকে লুকোচুরি

স্রোতের সাথে জীবন এবং কালু মাঝির অঙ্গীকার: জল-যুদ্ধ অনির্বাণ যখন গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন, তখন তার শরীর এবং মন—দু'টোই ছিল অবসন্ন। নদীর শীতল জল তার গায়ের ক্ষতগুলোকে যেন আরও বাড়িয়ে তুলল। তিনি স্রোতের টানে ভেসে চললেন, পেছনে রণজিতের সশস্ত্র দলের চিৎকার আর আধুনিক স্পিডবোটের আগমনী গর্জন শুনতে পেলেন। রণজিৎ চৌধুরী তার ক্ষমতা ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক তিনটি দ্রুতগতির লঞ্চ ভাড়া করে অনির্বাণের খোঁজে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এই লঞ্চগুলোতে ছিল অত্যাধুনিক ফ্লিপ-স্যানার (Flip-Sonar) ডিভাইস, যা নদীর গভীরে কোনো মানুষের শরীরের আকৃতি এবং চলাচল শনাক্ত করতে পারত। অনির্বাণ কোনোমতে একটি পুরোনো, জীর্ণ নৌকার নিচে লুকিয়ে রাখলেন। নৌকাটি ছিল একটি ছোট জেলে ডিঙি। নৌকার মালিক, বৃদ্ধ কালু মাঝি, অনির্বাণের হাতে নবাবী আমলের একটি পুরোনো মোহর দেখে এবং তার বিপদের আঁচ পেয়ে মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেন। কালু মাঝির পরিবার নবাবী আমল থেকে এই অঞ্চলের গুপ্তচরবৃত্তি এবং বার্তা আদান-প্রদানের কাজে নিয়োজিত ছিল। কালুর শিরায় সেই পুরোনো আনুগত্যের রক্ত বইছিল। "সাহেব," কালু মাঝি ভাঙা বাংলায় বললেন, "এ নদী বড় নিষ্ঠুর। তবে আপনার চোখ আর কথায় সেই মাটির গন্ধ আছে, যা নবাবদের ছিল। কোম্পানির লোকেরা আজও সেই গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আমার বাপ-ঠাকুরদাও এই পথেই নবাবের খাজনা আর গোপন বার্তা পারাপার করতেন। ভয় পাবেন না। আমার নৌকা কোম্পানির সোনাই হোক বা এখনকার 'বস'-এর প্রযুক্তিতেই হোক, কোনোদিন ধরা পড়েনি।" কালু মাঝি তাকে ছোট ছোট খাল ও চরের মধ্য দিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে চললেন। রণজিতের লোক, জামাইল, ড্রোন এবং স্যানার ব্যবহার করছিল। কিন্তু কালু মাঝির কৌশল ছিল অভূতপূর্ব। তিনি নৌকাটিকে এমন অগভীর চরের পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে স্যানার কাজ করত না, আর মাঝে মাঝে বিশাল পানিবাহী বার্জগুলোর নিচে এক মিনিট করে লুকিয়ে পড়ছিলেন, যাতে ড্রোন তাদের তাপের উৎস ট্র্যাক করতে না পারে। ভাগলপুরের চরে ভয়ঙ্কর ফাঁদ: জল ও বালির যুদ্ধ এবং জামাইলের সন্দেহ দ্বিতীয় দিন ভোরবেলা, ভাগলপুরের একটি বিশাল চরে তাদের প্রথম বড় বিপদ ঘটল। কালু মাঝির নৌকা যখন চরের কাছে পৌঁছাল, তখন তারা দেখলেন, প্রায় দশজন সশস্ত্র লোক চরের চারদিকে পজিশন নিয়েছে। রণজিৎ তাদের গতির রুট অনুমান করে সেখানে ফাঁদ পেতেছিলেন। "সাহেব, এরা আধুনিক শিকারী," কালু মাঝি সতর্ক করলেন। "কিন্তু চরের বালি আমাদের পক্ষে।" অনির্বাণ এবং কালু মাঝি দ্রুত নৌকা থেকে নামলেন। কালু মাঝি হঠাৎ কিছু বালি নিয়ে তার পুরোনো লণ্ঠন জ্বালিয়ে তার কাঁচের ওপর বসিয়ে দিলেন। এই লণ্ঠনের তাপ ড্রোনের ইনফ্রারেড সেন্সরে মানব শরীরের তাপের চেয়ে বেশি উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়ল। জামাইল দূর থেকে ভাবল, তারা লণ্ঠনটি রেখে পালাতে চাইছে। সশস্ত্র দলটি সেই লণ্ঠন লক্ষ্য করে ছুটে আসতেই কালু মাঝি অনির্বাণকে নিয়ে চরের উল্টো দিকের একটি ঘন কাশফুলের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লেন। এই ঝোপগুলো ছিল নবাবী আমলের এক গোপন লুকানোর জায়গা, যা কেবল স্থানীয়রাই জানত। কাশফুলের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা তাদের শরীরের তাপকে আরও ভালোভাবে লুকিয়ে রাখল। এই লুকোচুরি খেলার অংশ হিসেবে একবার গভীর রাতে একটি স্পিডবোট কালু মাঝির নৌকার খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। কালু মাঝি দ্রুত নৌকাটিকে একটি ভাসমান কচুরিপানার স্তূপের নিচে ঢুকিয়ে দিলেন। জামাইলের লোকেরা স্যানারে কোনো ধাতব বস্তু শনাক্ত করতে না পারায় ফিরে গেল। এই চরম উত্তেজনার মুহূর্তে অনির্বাণ নবাবের ফর্মুলাটি যেন আরও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলেন। তিনি বুঝলেন, এই সত্যকে রক্ষা করার জন্য কালু মাঝি নিজের জীবন বিপন্ন করছেন, কারণ এটি কেবল একটি দলিল নয়—এটি তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি। ইরার নীরব বার্তা: তামার মুদ্রা ও নৈতিক বিশ্বাসে ফাটল তিন দিন ধরে এই লুকোচুরি চলল। অনির্বাণ এক রাতে সীমান্ত সংলগ্ন একটি ছোট চরে লুকিয়ে ছিলেন। নদীর জল তখন নেমে গেছে। তার হাতে থাকা আল-কুতুবের কৌটাটি হঠাৎ মৃদুভাবে গরম হতে শুরু করল। এটি একটি অদ্ভুত সংকেত। আসলে, এটি ছিল ইরা দ্বারা প্রেরিত একটি এনক্রিপ্টেড রেডিও সিগন্যাল। ইরা তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। রণজিতের অহংকার এবং ইতিহাসের সত্যকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা তাকে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ফেলেছিল। সে তার প্রযুক্তির জ্ঞান ব্যবহার করে আল-কুতুবের কৌটায় একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে অতি-নিম্ন-শক্তির বার্তা পাঠায়, যা কেবল কৌটার 'রক্তের পথ' সেন্সরই ধরতে পারে। ঠিক তখনই, একটি কালো এসইউভি এসে চরের অপর প্রান্তে থামল। সেখান থেকে ইরা নেমে এলো। তার সঙ্গে ছিল দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী। ইরা জানত, অনির্বাণ কাছেই আছেন, কিন্তু সে তার দেহরক্ষীদের ভুল দিকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দিল। দেহরক্ষীরা চলে যাওয়ার পর, ইরা ধীরে ধীরে চরের বালির ওপর হাঁটতে শুরু করল। অনির্বাণ দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করলেন। ইরা যেন তার প্রতি এক ধরণের নীরব খেলা খেলছিল। সে হাঁটার সময় তার হাতের পুরোনো মানচিত্রের ছেঁড়া অংশ থেকে একটি ছোট, ভঙুর তামার মুদ্রা ফেলে দিল। মুদ্রাটি নবাব মীর কাসিমের সময়কার। মুদ্রাটির ওপর সূর্যের আলো পড়তেই অনির্বাণ দেখলেন, তার ওপর খোদাই করা একটি বিশেষ চিহ্ন—একমুখী তীর। এই তীরটি স্থানীয়দের কাছে নদীপথের এমন একটি গোপন শাখা-পথের ইঙ্গিত দিত, যা সরাসরি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যেখানে সাধারণত কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে যাওয়া যায়। মুদ্রাটির উল্টোদিকে ক্যালিগ্রাফিক অক্ষরে একটি অস্পষ্ট বার্তা ছিল: "পশ্চিমে সূর্য অস্ত যায়, পূর্বের পথেই মুক্তি।" এটি ছিল ইরার নীরব বার্তা: আমি জানি তুমি কোথায়, কিন্তু আমি তোমার পথ খুলে দিলাম। তোমার ঐতিহাসিক সত্যকে বাঁচানোর জন্য আমার বিশ্বাসঘাতকতার পথ বেছে নিতে হলো। ইরা দ্রুত ফিরে গিয়ে জামাইলকে জানাল, চরে কেউ নেই এবং ট্র্যাকারটি ভুল সঙ্কেত দিচ্ছে। কিন্তু এবার জামাইল সন্দেহ করল। "ইরা, তুমি কি নিশ্চিত? বস এর সন্দেহ হচ্ছে। ট্র্যাকার বলছে তাপের উৎস ছিল। তুমি কি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ?" জামাইলের চোখে সন্দেহ। ইরা দৃঢ়ভাবে জামাইলের চোখে তাকাল। "আমার ট্র্যাকিং ডেটা নির্ভুল। ডক্টর রায় একজন গবেষক, সামরিক কৌশলবিদ নন। সে ক্লান্ত হয়ে গেছে এবং হয়তো সীমান্ত পার হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের মনোযোগ এখন ঢাকাতে দেওয়া উচিত। এটাই নবাবের শেষ সঙ্কেত।" ইরা রণজিৎকে নিশ্চিত করল যে, অনির্বাণ ভুল পথে চলে গেছেন এবং তারা যেন সরাসরি ঢাকাতে 'সাত গম্বুজ'-এর কাছে সমস্ত বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত থাকে। ইরা এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনির্বাণকে সময় এবং নিরাপদ পথ দুটোই পাইয়ে দিল। অনির্বাণ সেই রাতে কালু মাঝির সাহায্যে সীমান্ত পার হলেন। পুরোনো নৌকা আর একমুঠো মাটির প্রতি মানুষের বিশ্বাস—এই ছিল আধুনিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে তার জয়।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion