বাতাসের গুহায় প্রবেশ
ভোর হওয়ার ঠিক আগে, যখন আকাশটা ধূসর হতে শুরু করেছে, তখন অনীশ আর ইলা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাল। একটা বিশাল জলপ্রপাত পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামছে। তার গর্জন বহু দূর থেকে শোনা যায়।
“গুহাটা ওই ঝর্ণার পেছনে,” ইলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। সে একটু থামল, তার মুখে একটা ভয়ের ছাপ। স্থানীয় কিংবদন্তিটা তার মনে পড়ে গেল।
(ফ্ল্যাশব্যাক শুরু)
অনেক ছোটবেলায় দাদু একবার তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। ছোট্ট ইলা গুহার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, “ভেতরে কী আছে দাদু?”
অরুণাভবাবু হেসেছিলেন। “ভেতরে আছে পাহাড়ের নিঃশ্বাস। লোকে বলে, এটা পাতালের দরজা। একবার ঢুকলে কেউ ফেরে না।”
ইলার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল। দাদু তখন তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “কিন্তু সব গল্পেরই একটা অন্য দিক থাকে, দিদিভাই। মনে রাখবি, যে বাতাস ভেতরে ঢোকে, তাকে বাইরে বেরোনোর রাস্তাও খুঁজে নিতে হয়। সব দরজা যা দিয়ে প্রবেশ করা যায়, তা দিয়ে বেরোনো যায় না। কিন্তু বেরোনোর জন্য সবসময় অন্য কোনো পথ থাকে। শুধু চোখ খোলা রাখতে হয়।”
(ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)
দাদুর সেই cryptic কথাটা আজ ইলার মনে নতুন করে সাহস জোগাল। ‘বেরোনোর জন্য সবসময় অন্য কোনো পথ থাকে।’ সে অনীশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। সে তৈরি।
তারা সাবধানে ঝর্ণার পাশ দিয়ে, পিচ্ছিল পাথরের ওপর পা ফেলে এগোতে লাগল। ঝর্ণার জলের ধারা একটা পর্দার মতো কাজ করছে, যা গুহার প্রবেশপথটাকে আড়াল করে রেখেছে। তারা সেই জলের পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই এক অন্য জগতে এসে পড়ল।
গুহার ভেতরটা স্যাঁতস্যাঁতে আর অন্ধকার। বাইরে ঝর্ণার গর্জনের জন্য আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তারা টর্চ জ্বেলে দেখল, গুহাটা বেশ বড়। তার দেওয়াল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে। বাতাসে একটা সোঁদা গন্ধ।
“এখন কোন দিকে যাব?” অনীশ জিজ্ঞেস করল।
ইলা কম্পাসটা বের করল। “কম্পাস অনুযায়ী, আমাদের সোজা যেতে হবে।”
তারা সাবধানে এগোতে লাগল। গুহার মেঝেটা অসমতল, জায়গায় জায়গায় জলের ডোবা। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তারা একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল, যেখানে গুহাটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
“এবার?” অনীশ আবার জিজ্ঞেস করল।
ইলা টর্চের আলোটা গুহার ছাদে ফেলল। “দেখুন!”
গুহার ছাদে, ঠিক যেখানে পথটা ভাগ হয়েছে, সেখানে একটা হাতে আঁকা চিহ্ন। একটা কুকরির ছবি। আর কুকরিটা ডানদিকের পথের দিকে নির্দেশ করছে।
“গ্রিফিন তার পথের চিহ্ন রেখে গেছে,” অনীশ উত্তেজিত হয়ে বলল। “সে জানত, যারা এই সংকেত সমাধান করতে পারবে, তাদের জন্য এই চিহ্নগুলো দরকার হবে।”
তারা ডানদিকের পথটা ধরল। পথটা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। এক জায়গায় তাদের প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হলো। অনীশের কাঁধের ক্ষতটা থেকে তখনো অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। তার শরীরটা দুর্বল হয়ে আসছিল। কিন্তু মনের জোরে সে এগিয়ে চলল।
অবশেষে, তারা একটা বিশাল চেম্বারের মতো জায়গায় এসে পৌঁছাল। জায়গাটা প্রায় একটা ঘরের মতো। তিনদিক পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। আর সামনের দিকে, চেম্বারের ঠিক মাঝখানে, একটা পাথরের বেদীর ওপর রাখা আছে একটা পুরনো, মরচে পড়া লোহার বাক্স।
অনীশ আর ইলা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, আনন্দ আর অবিশ্বাস। এতদিনের পরিশ্রম, এত বিপদ পেরিয়ে তারা অবশেষে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছে।
তারা কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটার দিকে এগিয়ে গেল। বাক্সটার ওপর কোনো তালা নেই, শুধু একটা ভারি লোহার খিল লাগানো। অনীশ তার সমস্ত শক্তি দিয়ে খিলটা সরাল। বাক্সটার ডালা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা বাতাস বেরিয়ে এল।
আর ভেতরে যা ছিল, তা দেখে তারা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভেতরে কোনো সোনাদানা, হীরে-জহরত বা কোনো গুপ্তধন ছিল না। ছিল কয়েকটা পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া ফাইল, একটা চামড়ায় বাঁধানো কোডবুক, আর একটা অদ্ভুত দেখতে যন্ত্র, যেটা দেখে মনে হচ্ছে একটা পুরনো দিনের শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার।
অনীশ সাবধানে একটা ফাইল তুলে নিল। ফাইলটার ওপর লেখা—’Operation Polaris’। সে ফাইলটা খুলল। ভেতরের লেখাগুলো ইংরেজি, কিন্তু হস্তাক্ষরটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। অনীশ তার লেখা আগে দেখেছে, তাই চিনতে ভুল হলো না।
সে পড়তে শুরু করল। আর পড়তে পড়তে তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল।
নথিগুলো থেকে যা জানা গেল, তা ভারতের প্রচলিত ইতিহাসকে একেবারে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন ব্রিটিশরা কোণঠাসা, তখন নেতাজি শুধু জার্মানি বা জাপানের ওপর ভরসা করে বসে ছিলেন না। তিনি সুইডেনের মতো একটি নিরপেক্ষ দেশের সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, সুইডিশ নেভির সাহায্যে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ পাঠানো হবে। এবং সেখান থেকে ব্রিটিশ ভারতের ওপর এক চূড়ান্ত আঘাত হানা হবে। এই পরিকল্পনার নামই ছিল ‘অপারেশন পোলারিস’, ধ্রুবতারার নামে।
গ্রিফিন, যে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিল, সে কোনোভাবে এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। কিন্তু সে ব্রিটিশদের প্রতি পুরোপুরি অনুগত ছিল না। তার মনে ভারতের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি ছিল। সে এই তথ্যটা তার সরকারের কাছে পুরোপুরি ফাঁস করেনি। পরিবর্তে, সে নেতাজির সাথে যোগাযোগকারী সুইডিশ এজেন্টের সাথে দেখা করে এবং পুরো পরিকল্পনাটা বানচাল করার বদলে সেটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তার উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধ শেষ হলে এই তথ্যটাকে ব্যবহার করে ভারতের জন্য ব্রিটিশদের কাছ থেকে আরও ভালো কোনো স্বাধীনতার শর্ত আদায় করা।
কিন্তু যুদ্ধের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। নেতাজি অন্তর্ধান করেন। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। গ্রিফিন বুঝতে পারে, এই তথ্য প্রকাশ পেলে নবগঠিত ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে। তাই সে এই 엄청난 গোপন তথ্যটাকে এই পাহাড়ের গভীরে লুকিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বাক্স, এই নথি, আর এই ট্রান্সমিটারটা হলো সেই পরিকল্পনার একমাত্র প্রমাণ। ট্রান্সমিটারটা রাখা হয়েছিল, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে সুইডিশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করা যায়। আর কোডবুকটা ছিল সেই যোগাযোগের সাংকেতিক ভাষা।
“অবিশ্বাস্য!” অনীশ ফিসফিস করে বলল। “এটা…এটা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গোপন তথ্যগুলোর একটা।” তার মনে হলো, এই নথির কোথাও হয়তো তার দাদুর নামেরও উল্লেখ থাকতে পারে।
ইলা তখনো বিস্ময়ে হতবাক। তার দাদু, তার পরিবার যে এত বড় একটা রহস্যের ওপর বসেছিল, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
কিন্তু তাদের এই বিস্ময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ করেই গুহার প্রবেশপথের দিক থেকে কয়েকটা টর্চের আলো এসে তাদের মুখের ওপর পড়ল। তার সাথে ভেসে এল একটা শান্ত, কিন্তু বরফ-শীতল গলা।
“খুবই আকর্ষণীয় আবিষ্কার, তাই না, মিস্টার সেনগুপ্ত?”
অনীশ আর ইলা চমকে ফিরে তাকাল। গুহার মুখে চার-পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লম্বা, সুদর্শন চেহারার লোক। তার পরনে দামী পোশাক, আর মুখে একটা সৌজন্যের হাসি, যা তার চোখের হিংস্রতাকে ঢাকতে পারছিল না।
“আমার নাম ক্রিস্টফ,” লোকটা এগিয়ে আসতে আসতে বলল। “আর আমরাই হচ্ছি সেই লোক, যারা চায় না এই ইতিহাসটা কোনোদিন দিনের আলো দেখুক।”
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion