সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়
রাতটা ছিল অন্ধকার, মেঘে ঢাকা। চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না। ঈগলস নেস্টের চারপাশে কুয়াশার এমন পুরু আস্তরণ জমেছিল যে কয়েক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। অনীশ আর ইলার জন্য এটাই ছিল সুযোগ।
তারা নিঃশব্দে বাংলোর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। মঙ্গলুদা, তাদের বিশ্বস্ত কাজের লোক, ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা তাকে কিছুই জানায়নি, কারণ তারা তার জীবন বিপন্ন করতে চায়নি। খালি পায়ে, গাছের আড়াল দিয়ে তারা এগোতে লাগল। তাদের লক্ষ্য ছিল মূল রাস্তা এড়িয়ে, পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথে এগিয়ে যাওয়া।
“ওরা নিশ্চয়ই মূল রাস্তায় নজর রাখছে,” অনীশ ফিসফিস করে বলল। “আমাদের জঙ্গলের পথটাই ধরতে হবে। আপনি পথ চেনেন?”
“ছোটবেলায় এই জঙ্গলে অনেক খেলেছি,” ইলা আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল। “চোখ বন্ধ করেও চলে যেতে পারব।”
তারা জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করল। চারপাশটা এতটাই অন্ধকার যে নিজের হাতও দেখা যায় না। টর্চ জ্বালানোর উপায় নেই, কারণ তাতে শত্রুরা তাদের অবস্থান জেনে যাবে। তারা শুধু ইলার অনুমানের ওপর ভরসা করে আর কম্পাসের কাঁটা দেখে এগোতে লাগল।
পাহাড়ি পথ পিচ্ছিল আর বিপদসংকুল। শুকনো পাতার ওপর পা পড়লে মচমচ শব্দ হচ্ছে, যা এই নিস্তব্ধতায় কামানের গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কেউ তাদের দেখে ফেলল। একবার একটা বুনো শেয়ালের ডাকে তারা এমনভাবে চমকে উঠেছিল যে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল।
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর তারা একটা ছোট ঝর্ণার কাছে এসে থামল একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। অনীশ তার বোতল থেকে জল খেল। “আপনার কি মনে হয়, ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে?”
“ওরা আমাদের চেয়েও বেশি চালাক, অনীশ,” ইলা বলল। “ওরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছে যে আমরা বাংলোতে নেই। হয়তো এতক্ষণে আমাদের খোঁজে বেরিয়েও পড়েছে।”
ইলার কথাই সত্যি হলো। হঠাৎ করেই তাদের পেছনে, কিছুটা দূরে, কয়েকটা টর্চের আলো দেখা গেল। আলো গুলো জঙ্গলের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরছে, যেন কিছু একটা খুঁজছে।
“সর্বনাশ! ওরা এসে গেছে!” অনীশ আতঙ্কিত গলায় বলল। “এখন কী হবে?”
“দৌড়াতে হবে,” ইলা অনীশের হাতটা শক্ত করে ধরল। “আর কোনো উপায় নেই। চলুন!”
শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর দৌড়। তারা আর লুকিয়ে চলার চেষ্টা করল না। পাথর, কাঁটা, ঝোপঝাড় মাড়িয়ে তারা পাগলের মতো দৌড়াতে লাগল। তাদের পেছনে টর্চের আলো আর কিছু মানুষের চিৎকারের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। একটা গুলি চলার শব্দও হলো, যা তাদের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
তারা দৌড়াতে দৌড়াতে একটা খাদের কিনারায় এসে পৌঁছাল। নিচে গভীর অন্ধকার। আর যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।
“আমরা আটকা পড়ে গেছি,” অনীশ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
“না, পড়িনি,” ইলা খাদের ধার ঘেঁষে একটা সরু পথের দিকে ইঙ্গিত করল। “এটা একটা পুরনো শিকারিদের পথ। খুব বিপজ্জনক, কিন্তু এটাই আমাদের একমাত্র বাঁচার রাস্তা।”
তারা সেই সরু পথটা ধরল। পথটা এতটাই সরু যে একজন মানুষ কোনোমতে যেতে পারে। একপাশে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, অন্যপাশে গভীর খাদ। একটু পা ফসকালেই মৃত্যু অনিবার্য। তাদের শত্রুরাও সেই পথের মুখে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু এই বিপজ্জনক পথে নামার সাহস তাদের হলো না। তারা ওপর থেকে গুলি চালাতে শুরু করল।
অনীশ আর ইলা কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে নিজেদের বাঁচাতে লাগল। একটা গুলি অনীশের কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল, চামড়া ছিঁড়ে দিয়ে গেল। সে যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
“আপনি ঠিক আছেন?” ইলা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমি ঠিক আছি। আমাদের এগোতে হবে,” অনীশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
তারা কোনোমতে সেই ভয়ঙ্কর পথটা পার হয়ে অন্য দিকে পৌঁছাল। তাদের শত্রুরা তখনো খাদের ওপারে দাঁড়িয়ে। এই দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে লাভ হবে না। তারা রাগে চিৎকার করতে লাগল।
অনীশ আর ইলা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। তারা আবার জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়ল। তারা জানে, বিপদ এখনো কাটেনি। শত্রুরা অন্য কোনো পথে তাদের ধরার চেষ্টা করবে। তাদের হাতে সময় খুব কম। সূর্য ওঠার আগেই তাদের সেই বাতাসি গুফায় পৌঁছাতে হবে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion