প্রথম সতর্কবার্তা
সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। অনীশ ধড়মড় করে উঠে বসল। রাতের ঘটনাটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। সে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে নিচে নেমে এল। ইলা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল। তার মুখটা থমথমে।
“কাল রাতে আলো চলে গিয়েছিল?” অনীশ জিজ্ঞেস করল।
ইলা তার দিকে না তাকিয়েই বলল, “ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। এখানে প্রায়ই হয়।” তার উত্তরটা এতটাই সংক্ষিপ্ত ছিল যে অনীশের মনে হলো, সে কিছু একটা লুকাচ্ছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে অনীশ তার ঘরে ফিরে এল জিনিসপত্র গোছাতে। আর তখনই তার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তার টেবিলের ওপর রাখা বই আর মানচিত্রগুলো এলোমেলো। তার ব্যাগটা খোলা, ভেতরের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। চুরি কিছু যায়নি, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে কেউ তার ঘরে ঢুকেছিল এবং কিছু একটা খুঁজছিল।
অনীশ ছুটে নিচে নেমে এল। ইলা তখন বাগানে কাজ করছিল। “আমার ঘরে কেউ ঢুকেছিল!” অনীশ উত্তেজিত গলায় বলল।
ইলা শান্তভাবে তার দিকে তাকাল। “আপনি হয়তো ভুল দেখছেন। এখানে আমি ছাড়া আর একজন কাজের লোক, মঙ্গলুদা থাকে। সে এমন কাজ করার লোক নয়।”
“আমি ভুল দেখছি না! আমার সব জিনিসপত্র ঘাঁটা হয়েছে। কাল রাতে আমি পায়ের শব্দও পেয়েছিলাম।”
ইলার মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। “দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম, এই জায়গাটা সুবিধের নয়। আপনি যদি থাকতে ভয় পান, তাহলে চলে যেতে পারেন।”
অনীশের খুব রাগ হলো। মেয়েটা তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, উল্টে তাকেই অবিশ্বাস করছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। সে বুঝতে পারছিল, এখানে একা লড়াই করা কঠিন হবে। কিন্তু সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল দরজার ওপর। দরজার পাল্লার ঠিক মাঝখানে, খুরপি বা ওই জাতীয় কোনো ধারালো জিনিস দিয়ে লাল রঙে কিছু একটা লেখা। রঙটা সিঁদুরের মতো চেনা লাগছে। লেখাটা একটাই শব্দ—”ফিরে যাও”।
অনীশের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এটা কোনো সাধারণ চুরি বা অনুসন্ধানের ঘটনা নয়। এটা একটা সরাসরি হুমকি। কেউ বা কারা চায় না সে এখানে থাকুক, এই বাড়ির ইতিহাস ঘাঁটুক। তার মানে, সে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। ডায়েরিটা সত্যিই আছে এবং তাতে এমন কিছু লেখা আছে যা কেউ প্রকাশ হতে দিতে চায় না।
সেদিন লাইব্রেরিতে ঢুকে অনীশের মনে হলো, সে যেন এক টাইম মেশিনে চড়ে বসেছে। উঁচু সিলিং পর্যন্ত কাঠের শেলফ, তাতে সারি সারি চামড়ায় বাঁধানো বই। বাতাসে পুরনো কাগজের সেই পরিচিত গন্ধ। অনীশ প্রথমে লাইব্রেরির ক্যাটালগটা দেখতে শুরু করল। স্যার গ্রিফিনের লেখা বা তার সম্পর্কিত কোনো বইয়ের উল্লেখ আছে কিনা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। অনীশ প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় একটা পুরনো লেজারের একেবারে শেষের পাতায় তার চোখ আটকে গেল। সেখানে পেন্সিলে খুব অস্পষ্টভাবে লেখা—’For the Eagle’s eye only – under the sleeping giant.’ অর্থাৎ, ‘শুধুমাত্র ঈগলের চোখের জন্য – ঘুমন্ত দৈত্যের নিচে।’
ঘুমন্ত দৈত্য? এর মানে কী হতে পারে? অনীশ লাইব্রেরির চারদিকে তাকাল। কোনো দৈত্যের মূর্তি বা ছবি তার চোখে পড়ল না। সে শেলফের বইগুলো নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। হঠাৎ একটা শেলফের একেবারে নিচের তাকে, কয়েকটা পুরনো আইনের বইয়ের পেছনে সে একটা ছোট কাঠের বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটার ওপর কোনো তালা নেই, শুধু একটা ছোট ছিটকিনি লাগানো।
অনীশের বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করতে লাগল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলল। কিন্তু ভেতরে কোনো ডায়েরি ছিল না। ছিল একটা পুরনো, মরচে পড়া লোহার কম্পাস আর একটা ছোট, চামড়ায় বাঁধানো নোটবুক। নোটবুকটা স্যার গ্রিফিনের নয়, হাতের লেখাটা বাঙালি। অনীশ প্রথম পাতাটা খুলল। সেখানে লেখা—শ্রী অরুণাভ রায়। এটা ইলার দাদুর নোটবুক!
অনীশ পাতা ওল্টাতে লাগল। বেশিরভাগ পাতাই খালি। শেষের দিকে কয়েকটা পাতায় কিছু কথা লেখা। একটা জায়গায় লেখা—”সব সত্যি কাগজে লেখা থাকে না। যা খুঁজছ, তা পথ দেখাবে।” আরেক জায়গায় লেখা—”ব্লেডের ডগায় ইতিহাস ঘুমায়।” ডায়েরির এক কোণে পেন্সিলে আঁকা একটা অদ্ভুত প্রতীক—একটা সর্পিল চক্রের মধ্যে একটি চোখ। প্রতীকটা অনীশের খুব চেনা মনে হলো, কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না।
এই কথাগুলোর কোনো মানে খুঁজে পেল না অনীশ। কিন্তু সে বুঝতে পারল, অরুণাভ রায়ও এই রহস্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। হয়তো তিনি সমাধানের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন। অনীশ নোটবুক আর কম্পাসটা সাবধানে ব্যাগে ভরে নিল। সে ঠিক করল, এই আবিষ্কারের কথা সে এখনই ইলাকে জানাবে না। মেয়েটা তাকে বিশ্বাস করে না। আগে তাকে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসার সময় অনীশের মনে হলো, কেউ যেন তাকে দেখছে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। পাইন বনের গভীরে যেন একটা ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল। অনীশ শিউরে উঠল। সে একা নয়। তার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর কেউ নজর রাখছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion