পাহাড়ের প্রহরী
পরদিন সকালে অনীশ ঠিক করল, শহরে যাবে। তার কিছু দরকারি জিনিস কেনার ছিল, আর সে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ঈগলস নেস্ট সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করতে চেয়েছিল। ইলাকে সে জানাল, সে একটু ঘুরে আসছে। ইলা কোনো আগ্রহ দেখাল না, শুধু মাথা নাড়ল।
দার্জিলিং-এর ম্যাল রোড আগের মতোই প্রাণচঞ্চল। টুরিস্টদের ভিড়, ঘোড়ার টগবগ শব্দ, ভুট্টার পোড়া গন্ধ—সব মিলিয়ে এক চেনা পরিবেশ। কিন্তু অনীশের মনটা ভালো ছিল না। তার বারবার মনে হচ্ছিল, ভিড়ের মধ্যেও কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সে কয়েকবার হঠাৎ করে পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু পরিচিত বা সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেল না।
ম্যালের এক কোণে, যেখানে টুরিস্টদের ভিড় কিছুটা কম, সেখানে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে। সেই গলির ভেতরেই ছিল দোকানটা—’হিমালয়ান কিউরিওস’। বাইরে কোনো চাকচিক্য নেই, সাইনবোর্ডের লেখা প্রায় মুছে গেছে। অনীশ কৌতূহলী হয়ে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরটা যেন এক অন্য জগৎ। ধূপের গন্ধ, পুরনো কাঠ আর পিতলের গন্ধ মিলেমিশে একাকার। থরে থরে সাজানো পুরনো থাংকা, মুখোশ, গোর্খা কুকরি আর তিব্বতি পুঁতির মালা। দোকানের এক কোণে একটা নিচু টুলে বসেছিলেন এক বৃদ্ধ। তার মুখ বলিরেখায় ঢাকা, কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল আর স্থির। যেন তিনি এই দোকানের মতোই প্রাচীন।
“কিছু খুঁজছেন?” বৃদ্ধের গলা শান্ত, কিন্তু গভীর।
“আমি শুধু দেখছিলাম,” অনীশ বলল। “আপনার সংগ্রহ তো অসাধারণ।”
বৃদ্ধ মৃদু হাসলেন। “যা হারিয়ে যায়, তার কিছু অংশ এখানে এসে আশ্রয় নেয়।”
অনীশ কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। “আচ্ছা, আপনি কি ঈগলস নেস্ট এস্টেটটাকে চেনেন?”
বৃদ্ধের উজ্জ্বল চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য অনীশের চোখের গভীরে তাকাল। তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল না, কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা বদলে গেল। “ঈগলের বাসা… অনেক উঁচু হয়। সেখানে পৌঁছাতে গেলে ডানা লাগে। আর যার ডানা নেই, তার পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।”
অনীশের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এই লোকটা রূপক ভাষায় কথা বলছে। সে কি কিছু জানে? “আমি স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিন সম্পর্কে গবেষণা করতে এসেছি,” অনীশ সরাসরি বলল।
“গ্রিফিন সাহেব,” বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। “তিনি শুধু শিকারি ছিলেন না, সংগ্রাহকও ছিলেন। কিন্তু তিনি যা সংগ্রহ করেছিলেন, তা কোনো আলমারিতে রাখা যায় না।” বৃদ্ধের দৃষ্টি অনীশের চোখের গভীরে। “আপনি কি শুধু সাহেবের জন্যই এসেছেন, নাকি নিজের শেকড়ের খোঁজে?”
এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে অনীশ চমকে গেল। লোকটা কি তার দাদুর কথা জানে? সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “দুটোই বলতে পারেন।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, যেন তিনি এটাই আশা করেছিলেন। “তাহলে আপনি সঠিক পথেই এসেছেন। কিন্তু মনে রাখবেন, পাহাড় যার কাছ থেকে কিছু নেয়, তাকে পরীক্ষা না করে ফিরিয়ে দেয় না।”
“আপনি কে?” অনীশ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল।
“আমার নাম দর্জি। লোকে তাই বলে। তবে আমাদের একটা অন্য পরিচয়ও আছে। আমরা ‘পাহাড়ের প্রহরী’ (Sentinels of the Mountain)।” মিস্টার দর্জি নিচু গলায় বলতে লাগলেন, “আমাদের কাজ ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়া নয়, বরং সঠিক সময় আসা পর্যন্ত তাকে রক্ষা করা এবং যোগ্য ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, কিছু সত্য সময়ের সাথে প্রকাশ পাওয়া উচিত। আমার দাদু স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিনকে চিনতেন। সাহেব যখন এই রহস্য লুকানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন আমার দাদুই তাকে সাহায্য করেছিলেন। সেই থেকেই আমাদের পরিবার বংশপরম্পরায় এই রহস্যের ওপর নজর রেখে আসছে। অরুণাভ রায় যখন খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন আমি তাকেও পরোক্ষভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অন্যেরা তাকে থামিয়ে দিল।”
“অন্যেরা? ‘দ্য কাস্টোডিয়ানস’?” অনীশ ফিসফিস করে বলল।
মিস্টার দর্জির চোখে এক ঝলক বিস্ময় খেলে গেল। “আপনি তাদের কথাও জানেন দেখছি। হ্যাঁ, তারা ইতিহাসকে চিরতরে মুছে ফেলতে চায়। আর আমরা তাকে রক্ষা করতে চাই। এখন আমরা আপনাকে পরীক্ষা করছি, অনীশ সেনগুপ্ত। দেখছি, আপনি এই গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য কিনা।”
তিনি কাউন্টারের ভেতর থেকে একটা ছোট, কারুকার্য করা পাথরের চাকতি বের করলেন। “এটাকে ‘লুং-তা’ বলে। এটা শুধু আপনাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে না, সঠিক দৃষ্টিও দেবে। এটা শুধু একটি ডিকোডার নয়, এটি একটি প্রতীক যা প্রমাণ করবে যে আপনিই সেই যোগ্য ব্যক্তি।”
অনীশ কাঁপা কাঁপা হাতে চাকতিটা নিল।
দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় বৃদ্ধ নিচু গলায় বললেন, “মনে রাখবেন, সব তালা চাবি দিয়ে খোলে না। কিছু তালা খোলে সঠিক দৃষ্টি দিয়ে। আপনার উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, পাহাড় আপনাকে পথ দেখাবে।”
গলির মুখে আসতেই তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে সে চমকে উঠল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, একজন বৃদ্ধ ভুটিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
“তুমি সমতলের মানুষ। পাহাড়ের ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না,” বৃদ্ধ ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল। “যে দৈত্য ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিও না। ফিরে যাও, নাহলে পাহাড় তোমাকে নিজের কোলে টেনে নেবে।”
কথাটা বলেই বৃদ্ধ ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। অনীশ এবার বুঝতে পারল, এই বৃদ্ধ ভুটিয়া ‘দ্য কাস্টোডিয়ানস’-এর লোক। দার্জিলিং-এর আনাচে কানাচে দুই গোষ্ঠীর লড়াই চলছে—একদল রহস্যকে রক্ষা করতে চায়, অন্যদল তাকে ধ্বংস করতে। আর সে এখন এই দুই শক্তির লড়াইয়ের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion