এক অনিচ্ছুক সঙ্গী
ঈগলস নেস্টে ফিরে অনীশ দেখল, ইলা বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে নেই। সে তার স্কেচবুক নিয়ে বাগানের এক কোণে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে কী যেন আঁকছিল। তার আনমনা ভাব দেখে অনীশের মনে হলো, এই মেয়েটির ভেতরেও একটা অন্য জগৎ আছে।
অনীশ আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে সোজা ইলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আমাকে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে হবে। এটা খুব জরুরি।”
ইলা স্কেচবুক থেকে চোখ না তুলেই বলল, “আমার কিছু শোনার নেই।”
“শুনতে আপনাকে হবে!” অনীশের গলায় এবার দৃঢ়তা। “কারণ এই বিপদটা শুধু আমার একার নয়, আপনারও। আপনার দাদুর মৃত্যুটা হয়তো স্বাভাবিক ছিল না।”
এই কথাটা finalmente ইলার মনোযোগ আকর্ষণ করল। সে স্কেচবুকটা বন্ধ করে অনীশের দিকে তাকাল। তার চোখে অবিশ্বাস, কিন্তু কৌতূহলও। “কী বলতে চান আপনি?”
অনীশ তাকে বাজারের ঘটনা, অ্যান্টিক দোকানের মালিক মিস্টার দর্জি এবং সেই রহস্যময় বৃদ্ধের হুমকির কথা সব খুলে বলল। সে তার নিজের ঘরে তল্লাশি এবং দরজার ওপর লেখা হুমকির কথাও আবার মনে করিয়ে দিল।
“এগুলো শুধু আমার কল্পনা নয়, ইলা। কেউ বা কারা মরিয়া হয়ে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। আর আপনার দাদু সেই রহস্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন বলেই হয়তো তাকে মরতে হয়েছে।”
ইলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মুখটা পাথরের মতো কঠিন। “দাদুর হার্ট দুর্বল ছিল। ডাক্তার তাই বলেছে।”
“ডাক্তারকে দিয়ে যা খুশি বলানো যায়,” অনীশ পাল্টা যুক্তি দিল। “আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনার দাদু, যিনি সারা জীবন এই বাড়িটাকে ভালোবেসেছেন, তিনি কেন শেষ বয়সে এতটা ভীত আর চিন্তিত থাকতেন? কেন তিনি আপনাকে বিপদের কথা সতর্ক করে গিয়েছিলেন?”
অনীশের কথাগুলো ইলার মনের গভীরে কোথাও একটা আঘাত করল। তার মনে পড়ল, শেষ কয়েক মাস দাদু সত্যিই কেমন যেন বদলে গিয়েছিলেন। একা একা লাইব্রেরিতে বসে থাকতেন, মাঝে মাঝে চমকে উঠতেন। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেন না। ইলা ভেবেছিল, এটা হয়তো বার্ধক্যের কারণে। কিন্তু এখন অনীশের কথা শুনে তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল।
(ফ্ল্যাশব্যাক শুরু)
হঠাৎ করেই ইলার মনে পড়ে গেল বছরখানেক আগের এক বিকেলের কথা। সে তার ক্যানভাসে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি আঁকছিল। তার দাদু, অরুণাভ রায়, পেছনে এসে দাঁড়ালেন।
“কী সুন্দর হয়েছে রে দিদিভাই,” তিনি ইলার মাথায় হাত রেখে বললেন। “তোর হাতে জাদু আছে। তোর তুলি পাহাড়ের আত্মাকে ধরতে পারে।”
ইলা হেসেছিল। “আমার স্বপ্ন কী জানো দাদু? আমি প্যারিসে যাব। লুভর মিউজিয়ামের সামনে বসে মোনালিসার ছবি আঁকব।”
অরুণাভবাবুর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গিয়েছিল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু শিকড়কে ভুলে যেতে নেই। আমাদের এই পরিবার, এই বাড়ি… এদের প্রতিও আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।” তিনি ইলার আঁকা ছবির দিকে তাকিয়েছিলেন। “এই পাহাড় শুধু পাথর আর বরফ নয়। এর বুকে অনেক গোপন কথা, অনেক না বলা ইতিহাস চাপা দেওয়া আছে। আমাদের পরিবার বংশপরম্পরায় সেই ইতিহাসের প্রহরী।”
“মানে?” ইলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
“সময় হলে সব বুঝবি,” দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। “শুধু মনে রাখিস, বিপদ যখন আসবে, তখন পাহাড়ই তোকে পথ দেখাবে। ভয় পাস না।”
(ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)
দাদুর সেই কথাগুলো আজ নতুন করে ইলার কানে বাজতে লাগল। ‘আমাদের পরিবার বংশপরম্পরায় সেই ইতিহাসের প্রহরী’—এই কথার অর্থ কী? তার শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন আর পরিবারের প্রতি এই অজানা দায়িত্ব—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
“আমি আপনাকে কী করে বিশ্বাস করব?” ইলা জিজ্ঞেস করল। তার গলায় আগের সেই শীতলতা নেই, আছে এক ধরনের অসহায়ত্ব।
অনীশ তার ব্যাগ থেকে অরুণাভ রায়ের নোটবুক আর সেই পুরনো কম্পাসটা বের করে ইলার হাতে দিল। “এটা আমি লাইব্রেরিতে পেয়েছি। আপনার দাদুও সেই ‘ঘুমন্ত দৈত্য’-এর কথা জানতেন।”
ইলা কাঁপা কাঁপা হাতে নোটবুকটা নিল। নিজের দাদুর চেনা হস্তাক্ষর দেখে তার চোখ ছলছল করে উঠল। সে পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল। “সব সত্যি কাগজে লেখা থাকে না… ব্লেডের ডগায় ইতিহাস ঘুমায়…” কথাগুলো সে বিড়বিড় করে পড়ল। ডায়েরির কোণে আঁকা সেই সর্পিল চোখের প্রতীকটা দেখে সে শিউরে উঠল। “এই চিহ্নটা… দাদু শেষ বয়সে প্রায়ই এটা আঁকতেন। বলতেন, এটা নাকি পাহাড়ের চোখ। সবকিছু দেখতে পায়।”
“এর মানে কী?” সে অনীশের দিকে তাকাল।
“আমি এখনো জানি না,” অনীশ সত্যিটা স্বীকার করল। “কিন্তু আমি নিশ্চিত, এর মধ্যেই কোনো সূত্র লুকিয়ে আছে। আর সেই কারণেই আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে।”
ঠিক সেই মুহূর্তে, বাংলোর পেছন দিক থেকে একটা তীব্র কিছু ভাঙার শব্দ এল। দুজনেই চমকে উঠল। তারা ছুটে বাংলোর পেছনে, যেখানে অরুণাভ রায়ের পুরনো স্টোররুমটা ছিল, সেদিকে গেল। দরজাটা হাট করে খোলা। ভেতরে সব জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। ঘরের এক কোণে রাখা অরুণাভ রায়ের একটা বিশাল পুরনো ট্রাঙ্ক, যেটা তিনি কাউকে ছুঁতেও দিতেন না, সেটার তালাটা ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। তালার পাশে লোহার রডের দাগ স্পষ্ট।
ইলার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এই ট্রাঙ্কটা ছিল তার দাদুর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। এর ভেতরে তার ছেলেবেলার স্মৃতি, তার ঠাকুমার ছবি, আরও কত কী ব্যক্তিগত জিনিস রাখা ছিল। কেউ সেই ট্রাঙ্কটা খোলার চেষ্টা করেছে! এই ঘটনাটা তার কাছে একটা ব্যক্তিগত আক্রমণের মতো মনে হলো। অনীশের ঘরে তল্লাশি বা বাজারের গুঞ্জন তাকে এতটা বিচলিত করেনি, যতটা করল তার দাদুর স্মৃতির ওপর এই আঘাত। তার ভেতরের শিল্পীসত্তা আর কর্তব্যের লড়াইয়ে কর্তব্যবোধই জিতে গেল।
“আপনি ঠিকই বলেছিলেন,” ইলা নিচু, কাঁপা গলায় বলল। “ওরা কিছু একটা খুঁজছে। আর সেটা পাওয়ার জন্য ওরা যেকোনো কিছু করতে পারে।”
তার চোখে আর সংশয় ছিল না। ছিল ভয়, রাগ আর এক ধরনের জেদ। সে অনীশের দিকে ফিরে তাকাল। “আমি আপনাকে সাহায্য করব। দাদুর মৃত্যুর পেছনে যদি অন্য কোনো কারণ থাকে, সেটা আমাকে জানতেই হবে। এই বাড়ির রহস্য আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।”
অনীশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে অবশেষে একজন সঙ্গী পেয়েছে। একজন অনিচ্ছুক সঙ্গী, কিন্তু এই মুহূর্তে তার জন্য এটাই অনেক। তারা দুজনে মিলে ঠিক করল, ট্রাঙ্কটা খুলে দেখবে। হয়তো এর ভেতরেই কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion