দাদুর উত্তরাধিকার
ট্রাঙ্কটা ছিল সেগুন কাঠের, তার ওপর পিতলের কারুকাজ। খুব ভারি। অনীশ আর ইলা ধরাধরি করে ওটাকে বাংলোর ভেতরে নিয়ে এল। ইলার কাছে চাবি ছিল। সে যখন কাঁপা হাতে তালাটা খুলল, তখন ভেতর থেকে এক ঝলক ন্যাপথলিনের গন্ধ বেরিয়ে এল।
ট্রাঙ্কের ভেতরে থরে থরে সাজানো পুরনো জিনিস। অরুণাভ রায়ের কলেজের সার্টিফিকেট, তার স্ত্রীর লেখা চিঠি, ইলার ছোটবেলার আঁকা ছবি। সবকিছুই খুব সাধারণ, ব্যক্তিগত। অনীশ আর ইলা হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় ট্রাঙ্কের একেবারে নিচে, একটা পুরনো শাল চাদরের তলায় ইলার হাতটা ঠেকল একটা কাঠের পাটাতনে, যা ট্রাঙ্কের মেঝের সাথে মসৃণভাবে মেশানো নয়।
“এখানে কিছু একটা আছে,” ইলা উত্তেজিত হয়ে বলল।
দুজন মিলে সাবধানে পাটাতনটা তুলতেই একটা গোপন খোপ বেরিয়ে পড়ল। আর তার ভেতরে যত্ন করে রাখা ছিল দুটি জিনিস—একটা পুরনো দিনের, ভারি পিতলের কম্পাস, যেটা অনীশ লাইব্রেরিতে পাওয়া কম্পাসটার চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত আর কারুকার্য করা। আর তার সাথে ছিল একটা ছোট, চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি।
ডায়েরিটা খুলতেই তারা দেখল, ওটা অরুণাভ রায়েরই লেখা। কিন্তু এটা তার ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়, এটা যেন একটা গবেষণার লগবুক। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা—’প্রজেক্ট ঈগল’।
অনীশ আর ইলা একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর তারা নিবিষ্ট মনে ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল।
প্রথম এন্ট্রি:
“আজ আমি নিশ্চিত হলাম, গ্রিফিনের ডায়েরিটা একটা ধাপ্পা। ওটা লোকদেখানো। আসল রহস্য লুকিয়ে আছে অন্য কোথাও। গ্রিফিন খুব চালাক লোক ছিল। সে জানত, তার মৃত্যুর পর অনেকেই তার লেখার খোঁজে আসবে। তাই সে সবার জন্য একটা টোপ ফেলে রেখে গেছে। আসল চাবিটা সে এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছে, যা শুধু ‘ঈগলের চোখ’ দিয়েই দেখা সম্ভব।”
দ্বিতীয় এন্ট্রি:
“লাইব্রেরিতে পাওয়া সূত্রটা—’ঘুমন্ত দৈত্যের নিচে’—আমাকে অনেকদিন ভাবিয়েছে। আমি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোনো দৈত্যের মূর্তি বা ছবি নেই। তাহলে? আজ হঠাৎ করে আমার মনে হলো, দৈত্যটা হয়তো কোনো বস্তু নয়, কোনো ধারণা। জ্ঞান। লাইব্রেরি হলো জ্ঞানের ভান্ডার। আর সবচেয়ে ভারি, সবচেয়ে পুরনো বইগুলো থাকে একেবারে নিচের তাকে। সেই আইনি বইগুলোর নিচে, যা কেউ কোনোদিন পড়ে না। সেখানেই আমি প্রথম সূত্রটা পেলাম—একটা সাধারণ কম্পাস আর আমার এই নোটবুকটা লেখার প্রেরণা।”
তৃতীয় এন্ট্রি:
“আজ আমি দ্বিতীয় সূত্রটা পেলাম। ‘ব্লেডের ডগায় ইতিহাস ঘুমায়।’ এর মানে কী হতে পারে? ছুরি? তলোয়ার? এই বাড়িতে গ্রিফিনের আমলের অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। আমি সবগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু কিছুই পাইনি। আমার মনে হচ্ছে, আমি কোথাও ভুল করছি। ব্লেড বলতে হয়তো আক্ষরিক অর্থেই ব্লেড বোঝানো হয়নি।”
শেষ এন্ট্রি:
“ওরা আবার এসেছিল। আমি বাগানে ছায়ামূর্তি দেখেছি। ওরা জানে আমি কিছু একটা পেয়েছি। আমার ভয় করছে। ইলার জন্য খুব চিন্তা হয়। আমি যদি কিছু একটা করে ফেলতে না পারি, তাহলে এই রহস্যটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে, আর আমার পরিবারও বিপদে পড়বে। আমাকে আরও গভীরে যেতে হবে। পথ দেখানোর জন্য যে জিনিসটা দরকার, সেটা আমি পেয়েছি। কিন্তু সেটা ব্যবহার করার চাবিকাঠি এখনো আমার অজানা। গ্রিফিন লিখেছিল, ‘When the North Star weeps over the sleeping lady, the path will be clear.’—যখন ধ্রুবতারা ঘুমন্ত রমনীর ওপর কাঁদবে, তখন পথ পরিষ্কার হবে। ঘুমন্ত রমনী? দার্জিলিং-এ? এর মানে কী?”
ডায়েরিটা এখানেই শেষ। অনীশ আর ইলা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। অরুণাভ রায় রহস্যের অনেকটাই সমাধান করে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, ডায়েরিটা একটা ধাপ্পা, আসল সূত্র অন্য কোথাও। তিনি কম্পাস, নোটবুক খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ সূত্রটা—’ঘুমন্ত রমনী’—তার কাছেও অজানা ছিল।
“ঘুমন্ত রমনী?” ইলা বিড়বিড় করল। “দার্জিলিং-এ এই নামে কোনো জায়গা আছে বলে তো শুনিনি।”
অনীশ চিন্তায় ডুবে গেল। “এটা হয়তো কোনো জায়গার নাম নয়। হয়তো এটা কোনো রূপক। আচ্ছা, দার্জিলিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্য কী?”
“কাঞ্চনজঙ্ঘা,” ইলা সাথে সাথে উত্তর দিল।
“ঠিক। কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালাকে অনেক সময় পাশ থেকে দেখলে মনে হয় না, একজন মহিলা শুয়ে আছে?”
ইলার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। “হ্যাঁ! স্লিপিং বুদ্ধা বা স্লিপিং লেডি রেঞ্জ তো বলে ওকে! তাহলে ‘ধ্রুবতারা যখন ঘুমন্ত রমনীর ওপর কাঁদবে’—এর মানে কী? ধ্রুবতারা তো কাঁদে না।”
“কাঁদে,” অনীশ মৃদুস্বরে বলল। “উল্কাপাত। ইংরেজিতে বলে ‘shooting star’ বা ‘weeping star’। তার মানে, কোনো নির্দিষ্ট রাতে, যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ঠিক ওপর উল্কাপাত দেখা যাবে, সেদিনই পথ পরিষ্কার হবে।”
“কিন্তু সেটা কবে?”
“সেটা জানার জন্য আমাদের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্যালেন্ডার দেখতে হবে,” অনীশ বলল। “কিন্তু তার আগে আমাদের ‘ব্লেড’-এর রহস্যটা সমাধান করতে হবে।”
তারা দুজনে মিলে ঠিক করল, পরদিন তারা আবার লাইব্রেরি আর বাংলোর আনাচকানাচ খুঁজবে। এখন তারা একা নয়। তারা দুজন। অরুণাভ রায়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর।
কিন্তু তারা জানত না, তাদের শত্রুও বসে নেই। তারা প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখছে। এবং তারা আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion