অতর্কিত হামলা
পরদিন সকালটা ছিল মেঘমুক্ত। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। অনীশ আর ইলা সকাল সকাল লাইব্রেরিতে কাজে লেগে গেল। তাদের মাথায় একটাই চিন্তা—’ব্লেড’।
“গ্রিফিনের শিকারের খুব শখ ছিল,” ইলা একটা পুরনো অ্যালবাম দেখতে দেখতে বলল। “এখানে অনেক ছবি আছে, যেখানে তার হাতে বন্দুক বা ছুরি দেখা যাচ্ছে।”
“কিন্তু আপনার দাদু তো লিখেছেন, তিনি সব অস্ত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন,” অনীশ মনে করিয়ে দিল। “আমার মনে হয়, আমরা ভুল জায়গায় খুঁজছি। ব্লেড বলতে শুধু অস্ত্র বোঝায় না। ঘাসের ডগাকেও ব্লেড বলে, আবার…”
কথাটা শেষ করার আগেই তার চোখ পড়ল লাইব্রেরির দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির ওপর। ছবিটা গ্রিফিনের, তার পাশে একজন গোর্খা সেনাপতি দাঁড়িয়ে আছেন। সেনাপতির কোমরে গোঁজা একটা অসাধারণ কারুকার্য করা কুকরি।
“কুকরি!” অনীশ প্রায় চিৎকার করে উঠল। “গোর্খাদের শৌর্য আর আত্মমর্যাদার প্রতীক। একটা কুকরি তো শুধু অস্ত্র নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ওটাও তো একটা ব্লেড!”
ইলা উত্তেজিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ! আমাদের স্টোররুমে দাদুর সংগ্রহ করা অনেক পুরনো জিনিস আছে। তার মধ্যে একটা কুকরিও ছিল বলে আমার মনে পড়ছে।”
দুজনে প্রায় দৌড়ে স্টোররুমে গেল। ঘরটা এখনো লন্ডভন্ড। তারা সাবধানে জিনিসপত্র সরাতে শুরু করল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর, একটা পুরনো কার্পেটের নিচে তারা পেল সেটা। একটা চামড়ার খাপে ভরা কুকরি। খাপটা খুবই সাধারণ, কিন্তু ভেতর থেকে যখন ব্লেডটা বের করা হলো, তখন তার হাতলটা দেখে অনীশের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
রূপোর হাতল, তার ওপর অবিশ্বাস্য সুন্দর আর জটিল নকশা খোদাই করা। নকশাগুলো কোনো সাধারণ কারুকার্য নয়। সেগুলো দেখতে অনেকটা…
“মানচিত্রের মতো,” ইলা অনীশের মনের কথাটা বলে উঠল।
ঠিক তাই। ওগুলো ছিল দার্জিলিং-এর পাহাড়ি অঞ্চলের টোপোগ্রাফিকাল কন্ট্যুর লাইনের মতো। অনীশ তার ব্যাগ থেকে একটা আধুনিক মানচিত্র বের করে মেলাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। নকশাগুলো সাংকেতিক, কোনো নির্দিষ্ট স্কেল মেনে করা হয়নি।
“এটা ব্যবহার করার জন্য নিশ্চয়ই কোনো চাবি আছে,” অনীশ হতাশ গলায় বলল। “শুধু এটা দিয়ে আমরা কিছুই করতে পারব না।”
তারা কুকরিটা নিয়ে লাইব্রেরিতে ফিরে এল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। বাগানের দিক থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। ইলা বলল, ” চলুন, বাইরে গিয়ে একটু চা খাওয়া যাক। মাথাটা ধরে গেছে।”
তারা বারান্দায় এসে বসল। মঙ্গলুদা গরম চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। অনীশ লক্ষ্য করল, মঙ্গলুদা আজ একটু বেশিই চুপচাপ। তার চোখেমুখে একটা চাপা উদ্বেগের ছাপ। সে যখন চায়ের কাপটা রাখছিল, তখন অনীশ দেখল তার হাতের কব্জিতে একটা তাজা আঁচড়ের দাগ।
“মঙ্গলুদা, আপনার হাতে কী হয়েছে?” অনীশ সহজভাবে জিজ্ঞেস করল।
মঙ্গলুদা চমকে উঠল। “কিছু না বাবু। বাগানে কাজ করতে গিয়ে লেগে গেছে।” কথাটা বলেই সে প্রায় ছুটে ভেতরে চলে গেল। তার এই অস্বাভাবিক আচরণ অনীশের মনে একটা সন্দেহের বীজ বুনে দিল।
হঠাৎ করেই অনীশের মনে হলো, শান্তিটা কেমন যেন অপ্রাকৃত। কোনো পাখির ডাক নেই, ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দও নেই। যেন পুরো প্রকৃতি কোনো কিছুর ভয়ে দম বন্ধ করে আছে।
আর ঠিক তখনই, বাগানের ঝোপের ভেতর থেকে দুটো ছায়ামূর্তি তাদের দিকে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল। তাদের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে মোটা লাঠি। কিছু বোঝার আগেই তারা বারান্দায় উঠে এসে অনীশকে আক্রমণ করল।
অনীশ কোনোমতে একপাশে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাল। ইলা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। একজন লোক ইলার দিকে এগিয়ে যেতেই অনীশ তার পথ আটকে দাঁড়াল। শুরু হলো এক অসম লড়াই। অনীশ কোনো পেশাদার যোদ্ধা নয়, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য সে মরিয়া হয়ে লড়ছিল। অন্য লোকটি তখন বাংলোর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল, সম্ভবত কুকরিটার খোঁজে।
ইলা ভয় পেলেও ঘাবড়ে গেল না। সে হাতের কাছে থাকা গরম চায়ের কেটলিটা তুলে নিয়ে লোকটার মুখে ছুঁড়ে মারল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। সেই সুযোগে অনীশ তার পেটে সজোরে একটা লাথি মারল। কিন্তু অন্য লোকটি ততক্ষণে সামলে নিয়ে অনীশের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করার জন্য হাত তুলেছে।
অনীশ চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জানে, এই আঘাতটা সে আটকাতে পারবে না। কিন্তু আঘাতটা এল না। সে চোখ খুলে দেখল, ইলা একটা ভারি ফুলদানি তুলে নিয়ে লোকটার মাথায় মেরেছে। লোকটা টাল সামলেতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল।
প্রথম লোকটা, যার মুখে চা পড়েছিল, সে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তার মুখের কাপড়টা খুলে ফেলল। আর তখনই অনীশ চমকে উঠল। লোকটার মুখটা ভারতীয় নয়। নীল চোখ, খাড়া নাক, সোনালী চুল—চেহারাটা পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশের মানুষের মতো।
লোকটা তার সঙ্গীকে ইশারা করল। তারা আর ঝুঁকি নিল না। দুজনে মিলে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বাগানের অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল।
অনীশ আর ইলা হাঁপাচ্ছিল। তাদের সারা শরীর কাঁপছে। তারা যে বেঁচে আছে, এটাই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
“ওরা…ওরা কারা?” ইলা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আমি জানি না,” অনীশ বলল। “কিন্তু ওরা সাধারণ গুন্ডা নয়। ওরা পেশাদার। আর ওরা বিদেশি।”
এই ঘটনাটা তাদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিল। এই রহস্যটা আর স্থানীয় নেই। এর সাথে আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র জড়িয়ে আছে। হারিয়ে যাওয়া নথি বা মানচিত্রে এমন কিছু আছে, যা কোনো বিদেশি শক্তি প্রকাশ হতে দিতে চায় না। আর তার জন্য তারা খুন করতেও পিছপা হবে না।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion