Episode 8723 words0 views

নেতাজির সংকেত : অষ্টম পর্ব

লুং-তা-এর রহস্য হামলার ঘটনাটা অনীশ আর ইলাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পারছিল, ঈগলস নেস্ট আর নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে আবার হামলা হতে পারে। সেদিন রাতে তারা দুজনেই ভয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না। পরদিন সকালে তারা ঠিক করল, বাইরে যাওয়া বা কাউকে খবর দেওয়াটা বোকামি হবে। তাদের শত্রুরা বাইরেই ওত পেতে আছে। একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় হলো এই বাংলোর লাইব্রেরি। তারা লাইব্রেরির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। “আমাদের হাতে বেশি সময় নেই,” অনীশ বলল। “ওরা আবার আসবে। তার আগেই আমাদের এই সাংকেতিক মানচিত্রের রহস্য ভেদ করতে হবে।” তারা কুকরিটা টেবিলের ওপর রাখল। তার পাশে রাখল অরুণাভ রায়ের ডায়েরি আর দুটো কম্পাস। “আপনার দাদু দুটো জিনিসের কথা লিখেছিলেন,” অনীশ চিন্তিতভাবে বলল। “একটা হলো ‘ব্লেড’, যেটা আমরা পেয়েছি। আরেকটা হলো ‘ঘুমন্ত রমনী’র ওপর ‘ধ্রুবতারার কান্না’।” “সেটা তো উল্কাপাত,” ইলা বলল। “কিন্তু কবে, সেটা আমরা কী করে জানব?” “আমার কাছে একটা উপায় আছে,” অনীশ তার ল্যাপটপ খুলল। “আমি কলকাতা থেকে বেরোনোর আগে গত পঞ্চাশ বছরের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ডেটা ডাউনলোড করে এনেছিলাম। যদি আমরা জানতে পারি, গ্রিফিন কবে এই সংকেতটা তৈরি করেছিল, তাহলে আমরা সেই সময়ের কাছাকাছি কোনো বড় উল্কাপাতের ঘটনা খুঁজে বের করতে পারব।” “কিন্তু আমরা সালটা কী করে জানব?” “গ্রিফিনের ছবিটার দিকে তাকান,” অনীশ দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করল। “ছবির নিচে একটা প্লেটে তার নাম আর একটা সাল লেখা আছে—১৮৮৮। ধরে নেওয়া যাক, সে এই সময়েই সংকেতটা তৈরি করেছিল।” অনীশ দ্রুত তার ল্যাপটপে ডেটাবেস সার্চ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “পেয়েছি! ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে, লিওনিড মিটিওর শাওয়ারের সময় দার্জিলিং থেকে একটা বড় উল্কাবৃষ্টি দেখা গিয়েছিল। আর তার গতিপথ ছিল ঠিক কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর দিয়ে!” “তাহলে তো আমরা একটা তারিখ পেলাম!” ইলা উত্তেজিত হয়ে বলল। “কিন্তু এই তারিখটা দিয়ে কী হবে?” “হয়তো এই তারিখটাই চাবি,” অনীশ বলল। সে কুকরির হাতলটা আবার মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু নকশাগুলো এতটাই জটিল যে তার কোনো অর্থ উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। সে হতাশ হয়ে পকেটে হাত রাখতেই তার আঙুলে ঠেকল সেই পাথরের চাকতিটা, যেটা সে মিস্টার দর্জির দোকান থেকে কিনেছিল। হঠাৎ করেই মিস্টার দর্জির কথাটা তার মনে পড়ল—”সব তালা চাবি দিয়ে খোলে না। কিছু তালা খোলে সঠিক দৃষ্টি দিয়ে।” অনীশ বুঝতে পারল, মিস্টার দর্জি তাকে শুধু একটি বস্তু দেননি, একটি পরীক্ষাতেও ফেলেছিলেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, অনীশ এই চাবির সঠিক ব্যবহার করতে পারে কিনা। অনীশ পকেট থেকে ‘লুং-তা’ চাকতিটা বের করল। সেটার মাঝখানে একটা ছোট ছিদ্র। সে কৌতূহলী হয়ে চাকতিটা কুকরির হাতলের ওপর ধরল। আর তখনই সে চমকে উঠল। চাকতির ছিদ্রটা দিয়ে হাতলের নকশার একটা বিশেষ অংশ দেখা যাচ্ছে—একটা তারা। আর চাকতির গায়ে খোদাই করা বিভিন্ন চিহ্নগুলো হাতলের অন্যান্য চিহ্নের সাথে মিলে গিয়ে কয়েকটা শব্দ তৈরি করছে—’TIGER’S EYE’। “পেয়ে গেছি!” অনীশ প্রায় চিৎকার করে উঠল। “চাবিটা হলো এই চাকতিটা! মিস্টার দর্জি, পাহাড়ের প্রহরী, তিনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন! ‘টাইগার’স আই’—এর মানে হলো টাইগার হিল! মানচিত্রের শুরুটা হবে টাইগার হিল থেকে!” এবার তারা নতুন উদ্যমে কাজে লেগে গেল। ‘লুং-তা’ চাকতিটা একটা ডিকোডার রিং-এর মতো কাজ করছিল। ওটাকে হাতলের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারা এক-একটি জায়গার নাম উদ্ধার করতে লাগল। প্রতিটি নক্ষত্র পাহাড়ের এক-একটি চূড়া বা মোড়ের দিকে নির্দেশ করছে। তারা সেই বিন্দুগুলো যোগ করতেই একটা স্পষ্ট পথ বেরিয়ে এল। পথটা টাইগার হিল থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে একটা জায়গায়, যার পাশে একটা জলপ্রপাতের চিহ্ন আঁকা। “আমি জায়গাটা চিনি,” ইলা মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে বলল। “ছোটবেলায় দাদুর সাথে ওদিকে যেতাম। ওখানে একটা পুরনো গুহা আছে। স্থানীয়রা বলে ‘বাতাসি গুফা’ বা ‘উইন্ড-ইটার’স ম’। ওরা বিশ্বাস করে, পাহাড়ের সব বাতাস ওই গুহার ভেতরে ঢুকে যায়। কিন্তু একটা কথা আছে, ওই গুহায় নাকি একবার ঢুকলে আর ফেরা যায় না। ওটা নাকি পাতালের দরজা।” অনীশ আর ইলার শরীর উত্তেজনায় কাঁপছিল। অবশেষে তারা সফল হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া নথিটি কোনো ডায়েরি বা কাগজ নয়, বরং এই কুকরির হাতলে খোদাই করা এক অবিশ্বাস্য সাংকেতিক মানচিত্র, যা এক গোপন গুহার দিকে নির্দেশ করছে। আর সেই গুহার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই ইতিহাস, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই ইতিহাস, যা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে জড়িত। “আমাদের এখুনি রওনা দিতে হবে,” অনীশ বলল। “ওরা যেকোনো মুহূর্তে আবার হামলা করতে পারে।” তারা প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র একটা ছোট ব্যাগে ভরে নিল। টর্চ, জল, ফার্স্ট এইড বক্স, আর অবশ্যই কুকরি, কম্পাস এবং সেই ‘লুং-তা’ চাকতিটা। তারা ঠিক করল, দিনের আলোয় বেরোবে না। রাতের অন্ধকারে, যখন কুয়াশা সবচেয়ে ঘন থাকে, তখনই তারা ঈগলস নেস্ট থেকে পালাবে। তাদের সামনে এক দীর্ঘ, বিপদসংকুল পথ। আর পেছনে একদল হিংস্র, নির্মম শত্রু। কিন্তু তাদের মনে কোনো ভয় ছিল না। ছিল শুধু এক তীব্র উত্তেজনা আর এক ঐতিহাসিক সত্যকে উন্মোচন করার অদম্য ইচ্ছা। পাহাড় তাদের ডাকছিল। আর সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে তাদের কোনো উপায় ছিল না। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion