Episode 41225 words0 views

নিশাচর প্রহরী : চতুর্থ অধ্যায়

স্মৃতির চুরি অরুণ যখন তার প্রিয় গল্পগুলো মনে মনে আবৃত্তি করছিল, ছায়াদের নেতার শরীর থেকে কালো ধোঁয়া আরও তীব্রভাবে বেরিয়ে আসতে লাগল। তার শরীরটা যেন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল, আর তার শক্তি কমে যাচ্ছিল। আভা অরুণের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সোনালী গুঁড়ো ছড়াতে লাগল, যা ছায়াদের নেতার উপর একরকম আলোর জাল তৈরি করছিল, যা তাকে আটকে রাখছিল, তার শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছিল। কিন্তু স্মৃতিভোজী রাজা সহজে হার মানার পাত্র ছিল না। সে তার শেষ শক্তি দিয়ে একটি তীব্র গর্জন করল, যা পুরো ছায়ার শহরকে কাঁপিয়ে তুলল, প্রতিটি কালো স্তম্ভ যেন কেঁপে উঠল, তাদের ভিত্তি নড়ে গেল। তার শরীর থেকে অসংখ্য ছোট ছোট ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে অরুণের দিকে ধেয়ে এল। এই ছায়ামূর্তিগুলো ছিল অরুণের মনে লুকিয়ে থাকা ভয়, তার সন্দেহ, তার একাকীত্বের প্রতীক। তারা অরুণের মনকে গ্রাস করতে চাইল, তার স্মৃতিগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইল, তাকে অস্তিত্বহীন করে দিতে চাইল। অরুণের মনে ভেসে উঠল তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিগুলো—তার বাবা-মায়ের অকাল মৃত্যু, লাইব্রেরির জৌলুস হারানো, তার একাকী জীবন, যা তাকে গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন করে তুলছিল। এই স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তাকে আক্রমণ করছিল, তার আত্মাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। অরুণের মনে হলো যেন সে এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তার সমস্ত স্মৃতি বিলীন হয়ে যাবে। অরুণ অনুভব করল, তার মন অন্ধকার হয়ে আসছে। তার প্রিয় গল্পগুলো যেন তার স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে, তার প্রিয় চরিত্রগুলো যেন তার মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, যেন তার অস্তিত্বের ভিত্তি নড়ে যাচ্ছে। তার মনে ভয় জাগল। সে যদি তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে কীভাবে ছায়াদের বিরুদ্ধে লড়বে? তার অস্তিত্বই তো বিপন্ন হয়ে যাবে, সে নিজেও একটি ছায়ায় পরিণত হবে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করল, তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তার চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছিল, যেন সে জ্ঞান হারাতে চলেছে। তার মস্তিষ্ক যেন হাজারো স্মৃতিকে একসাথে ধারণ করতে পারছিল না, এক তীব্র চাপ অনুভব করছিল। “ভয় পেও না!” আভা চিৎকার করে বলল, তার কণ্ঠস্বর যেন অরুণের মনের গভীরে প্রবেশ করল, তাকে জাগিয়ে তুলল। “ওরা তোমার ভয়কে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে। তোমার মনকে দৃঢ় রাখো! তোমার গল্পগুলোকে মনে রাখো! তুমি একা নও! আমরা তোমার সাথে আছি! তোমার বিশ্বাসই তোমাকে রক্ষা করবে!” অরুণ নিজেকে সামলে নিল। সে তার মনে জোর করে তার প্রিয় চরিত্রগুলোকে ফিরিয়ে আনল। সে ভাবল সেই সাহসী যোদ্ধার কথা যে একা শত শত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছিল, সেই প্রেমিকার কথা যে তার ভালোবাসার জন্য সব বাধা অতিক্রম করেছিল, সেই বিজ্ঞানীর কথা যে তার আবিষ্কার দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল। সে ভাবল তার প্রিয় লাইব্রেরির কথা, প্রতিটি বইয়ের কথা, যা তাকে এত বছর ধরে সঙ্গ দিয়েছে, তাকে জ্ঞান আর সাহস জুগিয়েছে। এই চরিত্রগুলো তার মনে শক্তি জোগাল, তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনল, তার মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করল। তার মন থেকে অন্ধকার দূর হতে শুরু করল। ছायামূর্তিগুলো তার মন থেকে সরে যেতে লাগল, আর তার প্রিয় গল্পগুলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাদের আলোয় তার মন আলোকিত হয়ে উঠল। স্মৃতিভোজী রাজা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। তার শরীরটা যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তার কালো ধোঁয়া ক্রমশ হালকা হয়ে আসছিল, তার শক্তি কমে যাচ্ছিল। “তুমি আমাদের হারাতে পারবে না!” স্মৃতিভোজী রাজা শেষবারের মতো গর্জন করল, তার কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্র ঘৃণা আর হতাশা, যেন সে তার শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। তার লাল চোখগুলো নিভে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথায় ছিল একরকম শীতল প্রতিজ্ঞা। “আমরা আবার ফিরে আসব! যতক্ষণ মানুষ গল্প ভুলে যাবে, আমরা ততদিন শক্তিশালী হব! এই যুদ্ধ শেষ হয়নি, প্রহরী! আমরা চিরন্তন! আমরা শুধু অপেক্ষা করব, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকব, সুযোগের অপেক্ষায়!” তার শেষ কথাগুলো অরুণের কানে এক অশুভ প্রতিজ্ঞার মতো বাজছিল। তারপর, এক ঝলক আলোর সাথে সাথে স্মৃতিভোজী রাজা অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সাথে সাথে ছোট ছোট ছায়ামূর্তিগুলোও মিলিয়ে গেল, যেন তারা বাতাসে মিশে গেল, তাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল। ছায়ার শহরটা যেন কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠল, আর তার অন্ধকার কিছুটা দূর হলো। কিন্তু একটি চাপা অস্থিরতা রয়ে গেল, যেন তারা যেকোনো মুহূর্তে আবার ফিরে আসতে পারে, যেন এই বিজয় ক্ষণস্থায়ী, একটি সাময়িক স্বস্তি মাত্র। বাতাসে একরকম অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল, যা আগের কোলাহলের চেয়েও বেশি ভীতিকর ছিল। অরুণ হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে বসে পড়ল। তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু তার মন শান্ত। সে ছায়াদের নেতাকে হারিয়েছে। কিন্তু আভার কথা শুনে তার মনে এক প্রশ্ন জাগল—”যতক্ষণ মানুষ গল্প ভুলে যাবে, আমরা ততদিন শক্তিশালী হব!” এর মানে কী? এই যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ হয়েছে, নাকি এটি শুধু একটি বিরতি, একটি নতুন পর্যায়ের সূচনা? “ওরা আবার ফিরে আসবে,” আভা অরুণের পাশে এসে বসল। তার আলো কিছুটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে, যেন সেও এই যুদ্ধে ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখে ছিল একরকম দৃঢ়তা, এক গভীর জ্ঞান। “ওরা পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। ওরা শুধু দুর্বল হয়ে গেছে। ওদের মূল উৎস এখনও অক্ষত। ওরা শুধু ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে, মানুষের ভুলের অপেক্ষায়।” “কিন্তু কেন?” অরুণ প্রশ্ন করল। “কেন ওরা গল্প আর স্মৃতি চুরি করে? ওদের উদ্দেশ্য কী? ওরা কী চায়? ওদের অস্তিত্বের রহস্য কী?” “কারণ ওরা অস্তিত্বহীন সত্তা,” আভা ব্যাখ্যা করল। “ওদের কোনো নিজস্ব গল্প নেই, কোনো নিজস্ব স্মৃতি নেই। তাই ওরা অন্যের গল্প আর স্মৃতি চুরি করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। যখন মানুষ কোনো গল্প ভুলে যায়, যখন কোনো বই ধুলো জমা হয়ে পড়ে থাকে, তখন সেই গল্পের অস্তিত্বের টুকরোগুলো ছায়াদের জগতে চলে যায়। ওরা সেই টুকরোগুলোকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। ওরা চায় সমস্ত গল্প, সমস্ত স্মৃতি গ্রাস করে নিজেদেরকে একমাত্র অস্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে, এই জগৎকে নিজেদের দখলে নিতে এবং সমস্ত জ্ঞানকে নিজেদের অন্ধকার শক্তিতে রূপান্তরিত করতে।” অরুণ বুঝতে পারল, তার ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরি জীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণ। মানুষ যখন বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে, যখন লাইব্রেরিটা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, তখন বইগুলোর গল্পগুলো দুর্বল হয়ে গেছে, আর ছায়ারা সেই সুযোগটা নিয়েছে। লাইব্রেরিটা শুধু একটি ভবন নয়, এটি ছিল একটি প্রবেশদ্বার, যেখানে ছায়ারা মানুষের জগতে প্রবেশ করতে পারছিল, তাদের অন্ধকার শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, এবং মানুষের মনকে কলুষিত করছিল। “তাহলে আমাদের কী করতে হবে?” অরুণ প্রশ্ন করল। “কীভাবে ওদের পুরোপুরি হারানো যাবে? ওদের মূল উৎস কোথায়? আমাদের কি আরও গভীরে যেতে হবে, এমন এক জায়গায় যা কেউ জানে না?” “তোমাকে হারানো ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে,” আভা বলল। “এই বইয়ের জগতে এমন কিছু পুরোনো পুঁথি আছে, এমন কিছু বিস্মৃত ইতিহাস আছে, যা ছায়াদের দুর্বলতার মূল কারণ। ওরা সেই ইতিহাসগুলোকে গ্রাস করতে চায়, যাতে কেউ ওদের দুর্বলতা জানতে না পারে। সেই পুঁথিতেই ওদের চিরতরে ধ্বংস করার উপায় লেখা আছে। এটিই আমাদের শেষ আশা, মানবজাতির শেষ আশ্রয়।” “কোথায় পাব সেই ইতিহাস?” অরুণ প্রশ্ন করল, তার মনে এক নতুন আশার আলো জ্বলে উঠল, তার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প, যা তাকে অদম্য করে তুলেছিল। “এই বইয়ের জগতের গভীরে,” আভা বলল। “সেখানে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে পুরোনো দিনের জ্ঞান আর স্মৃতি লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই জায়গাগুলো ছায়াদের দ্বারা সুরক্ষিত। ওরা জানে, সেই জ্ঞান ওদের জন্য কতটা বিপজ্জনক। এটি ‘জ্ঞানের দুর্গ’ নামে পরিচিত, যেখানে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব।” অরুণ উঠে দাঁড়াল। তার মনে এক নতুন সংকল্প জন্ম নিল। তাকে সেই হারানো ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। তাকে তার লাইব্রেরিকে বাঁচাতে হবে, এই বইয়ের জগৎকে বাঁচাতে হবে, এবং সমস্ত গল্পকে ছায়াদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, যা তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। “আমি প্রস্তুত,” অরুণ বলল। “আমাকে পথ দেখাও, আভা। আমরা এই যুদ্ধ শেষ করব, চিরতরে। কোনো মূল্যেই হোক।” আভা অরুণের চারপাশে ঘুরতে লাগল, আর তার আলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “চলো তাহলে, হারানো ইতিহাসের সন্ধানে। পথটা সহজ হবে না, প্রহরী। প্রতিটি পদক্ষেপে বিপদ লুকিয়ে আছে, প্রতিটি মোড়ে ছায়াদের ফাঁদ। কিন্তু আমরা একসাথে লড়ব, এবং আমরা জিতব। তোমার বিশ্বাসই তোমার শক্তি।” তারা ছায়ার শহর থেকে বেরিয়ে এল, আর আবার সেই আলোকিত করিডোরে প্রবেশ করল। অরুণ জানত, তার সামনে এক কঠিন পথ অপেক্ষা করছে। কিন্তু সে একা ছিল না। তার সাথে ছিল আভা, আর তার মনে ছিল হাজারো গল্পের শক্তি, যা তাকে অদম্য করে তুলেছিল। তার মনে হলো, এই যাত্রা শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং সমস্ত মানবজাতির জন্য, যারা গল্প আর স্মৃতিকে ভালোবাসে, এবং যারা জ্ঞানের আলোতে বিশ্বাস করে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion