হারানো ইতিহাসের সন্ধানে
আভা অরুণের সামনে উড়তে উড়তে তাকে পথ দেখাচ্ছিল। তার সোনালী আলোয় করিডোরের অন্ধকার কিছুটা দূর হচ্ছিল, কিন্তু চারপাশে ছায়ামূর্তিগুলোর ফিসফিসানি আর লাল চোখের ঝলকানি এক অদ্ভুত ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করছিল। অরুণের মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য চোখ তাকে প্রতিটি মুহূর্তে অনুসরণ করছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন নীরবতার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যা তার মনে একরকম অস্থিরতা তৈরি করছিল। অরুণ দেখল, এই করিডোরটি যেন অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, প্রতিটি শাখা একটি ভিন্ন জগতের দিকে চলে গেছে, যেখানে প্রতিটি গল্পের জগৎ একে অপরের সাথে মিশে আছে, যেন এক বিশাল, জটিল মাকড়সার জাল, যা অনন্তকাল ধরে বিস্তৃত। প্রতিটি মোড়ে নতুন নতুন ছায়ামূর্তি তাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছিল, যেন তারা অরুণের দুর্বলতা খুঁজছে, তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।
“হারানো ইতিহাস কোথায় লুকিয়ে আছে?” অরুণ আভা-কে প্রশ্ন করল, তার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প, তার মনে ছিল এক নতুন আশার ঝলক।
“সেটা লুকিয়ে আছে ‘স্মৃতির গোলকধাঁধা’-য়,” আভা বলল। “সেখানে অতীতের সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত জ্ঞান জমা আছে। কিন্তু ছায়ারা সেই গোলকধাঁধাকে সুরক্ষিত করে রেখেছে, যাতে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। গোলকধাঁধার প্রতিটি মোড়ে ওদের ফাঁদ পাতা আছে, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়, এবং তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে প্রস্তুত।”
অরুণ ‘স্মৃতির গোলকধাঁধা’র কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত হলো। গোলকধাঁধা মানেই জটিল পথ, আর ছায়াদের সুরক্ষা মানেই বিপদ। তার মনে পড়ল, ছায়ারা কীভাবে তার স্মৃতি চুরি করতে চেয়েছিল, কীভাবে তারা তার মনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছিল। তার মনে এক চাপা ভয় জাগল, এই গোলকধাঁধা হয়তো তার শেষ পরীক্ষা।
তারা একটি বিশাল, অন্ধকার গর্তের সামনে এসে দাঁড়াল। গর্তের গভীরতা এতটাই বেশি যে তার শেষ দেখা যায় না, যেন এটি অনন্ত শূন্যতার দিকে চলে গেছে। গর্তের চারপাশে কালো ধোঁয়া ঘুরছে, যা থেকে একরকম ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছে, যা অরুণের শরীরকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, তার শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। গর্তের মুখ থেকে একরকম অশুভ শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যা তার মনে এক তীব্র ভয় জাগাচ্ছিল, তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল।
“এটা স্মৃতির গোলকধাঁধার প্রবেশপথ,” আভা বলল। “এর ভেতরে প্রবেশ করলে তুমি তোমার নিজের স্মৃতিও হারাতে পারো। তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। তোমার মনকে দৃঢ় রাখতে হবে। তোমার বিশ্বাসই তোমার একমাত্র অস্ত্র, যা তোমাকে রক্ষা করবে।”
“কীভাবে প্রবেশ করব?” অরুণ প্রশ্ন করল, তার কপালে চিন্তার ভাঁজ, তার মনে একরকম সংশয়।
“তোমাকে তোমার মনকে শান্ত রাখতে হবে,” আভা বলল। “তোমার মন যদি শান্ত থাকে, তাহলে তুমি পথ খুঁজে পাবে। আর যদি ভয় পাও, তাহলে তুমি গোলকধাঁধার ভেতরেই হারিয়ে যাবে, তোমার স্মৃতিগুলো ছায়াদের খাদ্য হয়ে যাবে। তোমার আত্মবিশ্বাসই তোমাকে পথ দেখাবে, তোমার ভেতরের আলোই তোমার একমাত্র দিশা।”
অরুণ চোখ বন্ধ করল। সে তার মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সে তার প্রিয় লাইব্রেরির কথা ভাবল, তার প্রিয় বইগুলোর কথা ভাবল। তার মনে এক দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিল। সে ভয় পাবে না। সে তার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত সাহস একত্রিত করল, তার মনে এক নতুন শক্তি অনুভব করল, যা তাকে অদম্য করে তুলল।
সে সাবধানে গর্তের ভেতরে পা রাখল। তার পায়ের নিচে কোনো কঠিন ভূমি ছিল না, যেন সে বাতাসে ভেসে যাচ্ছে, এক অদৃশ্য শক্তির উপর ভর করে। তার চারপাশে অন্ধকার, আর তার কানে ভেসে আসছে অসংখ্য ফিসফিসানি, যেন হাজারো স্মৃতি তাকে ডাকছে, তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে, তাকে তাদের দিকে টানছে, তার মনকে কলুষিত করতে চাইছে।
“এগুলো স্মৃতির টুকরো,” আভা বলল। “ওরা তোমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। ওদের কথায় কান দিও না। তোমার লক্ষ্য মনে রাখো। তোমার হৃদয়ের আলোই তোমার পথপ্রদর্শক, যা তোমাকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে।”
অরুণ তার মনকে দৃঢ় রাখল। সে তার সামনে থাকা লক্ষ্যকে মনে রাখল—হারানো ইতিহাস খুঁজে বের করা। সে অনুভব করল, তার সামনে একটি হালকা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। সে সেই আলোর রেখা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল, যেন আলোটি তাকে পথ দেখাচ্ছে, তার মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করছে। কিন্তু পথটা ছিল পিচ্ছিল, যেন সে কোনো অদৃশ্য বরফের উপর দিয়ে হাঁটছে।
গোলকধাঁধার ভেতরে পথটা ছিল অদ্ভুত। কখনও পথটা সরু হয়ে যাচ্ছিল, যেখানে অরুণকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হচ্ছিল, তার শরীর যেন পাথরের দেয়ালের সাথে ঘষা খাচ্ছিল। কখনও আবার বিশাল হলঘরের মতো প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছিল, যেখানে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন সে এক বিশাল গুহার ভেতরে প্রবেশ করেছে। কখনও পথটা উপরে উঠছিল, কখনও আবার নিচে নামছিল, যেন সে এক অজানা পাহাড়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। প্রতিটি মোড়ে অরুণ দেখল, ছায়ামূর্তিগুলো তাকে অনুসরণ করছে, তাদের লাল চোখ থেকে তীব্র আলো বেরিয়ে আসছে, যেন তারা তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে চাইছে। কখনও কখনও ছায়ামূর্তিগুলো অরুণের প্রিয়জনের রূপ ধারণ করে তাকে ডাকছিল, তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছিল, তার মনকে দুর্বল করে দিতে চাইছিল, তাদের কণ্ঠস্বর ছিল তার প্রিয়জনের মতো মিষ্টি, কিন্তু তাদের চোখ ছিল লাল।
“ওরা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে,” আভা বলল। “ওদের শক্তি কমে গেছে, তাই ওরা সরাসরি আক্রমণ করতে পারছে না। ওরা শুধু তোমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। ওদের ফাঁদে পা দিও না। তোমার বিশ্বাসই তোমাকে রক্ষা করবে, তোমার আত্মাকে পবিত্র রাখবে।”
অরুণ ছায়ামূর্তিগুলোর দিকে মনোযোগ দিল না। সে তার মনকে শান্ত রাখল, আর আলোর রেখা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। তার মনে হলো, এই গোলকধাঁধা যেন তার নিজের মনের প্রতিচ্ছবি। তার মনে লুকিয়ে থাকা ভয়, তার সন্দেহ, তার একাকীত্ব—সবকিছুই যেন ছায়ামূর্তি হয়ে তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু সে জানত, তাকে এই ভয়কে জয় করতে হবে, তার আত্মাকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, তার বিশ্বাসকে অটল রাখতে হবে।
দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর, অরুণ একটি বিশাল হলঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। হলঘরটি ছিল আলোকিত, আর তার মাঝখানে একটি বিশাল, উজ্জ্বল গোলok ভাসছিল। গোলকটি থেকে অসংখ্য আলোর রেখা বেরিয়ে আসছিল, যা হলঘরের দেয়ালকে আলোকিত করে তুলছিল। গোলকের চারপাশে অসংখ্য ছোট ছোট চিত্র ভেসে উঠছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন অতীতের কোনো ঘটনা, কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, যা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে।
“এটা স্মৃতির গোলক,” আভা বলল। “এর ভেতরেই হারানো ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই গোলকটি সমস্ত জ্ঞান আর স্মৃতির ভাণ্ডার, যা এই বইয়ের জগতের মূল ভিত্তি। এটিই আমাদের শেষ আশা।”
অরুণ গোলকের দিকে এগিয়ে গেল। গোলকটি থেকে একরকম উষ্ণতা বেরিয়ে আসছিল, যা তার শরীরকে শান্ত করে তুলল, তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল। সে গোলকটি স্পর্শ করল। তার মনে হলো যেন সে সমস্ত জ্ঞান আর স্মৃতির সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে, তার আত্মা যেন জ্ঞানের সমুদ্রে ডুব দিয়েছে।
তার হাতের স্পর্শে গোলকটি থেকে অসংখ্য চিত্র ভেসে উঠল, যা অরুণের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। সে দেখল, পুরোনো দিনের জ্ঞানীরা কীভাবে এই বইয়ের জগৎ তৈরি করেছিল, কীভাবে তারা গল্পগুলোকে প্রাণ দিয়েছিল, কীভাবে তারা জ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। সে দেখল, কীভাবে ছায়ারা ধীরে ধীরে এই জগতে প্রবেশ করেছিল, আর কীভাবে তারা গল্প আর স্মৃতি চুরি করা শুরু করেছিল, তাদের অন্ধকার শক্তি দিয়ে এই জগৎকে গ্রাস করতে চেয়েছিল। সে দেখল, কীভাবে প্রাচীন প্রহরীরা ছায়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল, এবং কীভাবে তারা এই পুঁথিটি লুকিয়ে রেখেছিল, তাদের শেষ আশার প্রতীক হিসেবে।
সে আরও দেখল, একটি প্রাচীন পুঁথির কথা। এই পুঁথিটি ছিল ছায়াদের দুর্বলতার মূল কারণ। পুঁথিটিতে এমন কিছু মন্ত্র আর কৌশল লেখা ছিল, যা দিয়ে ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করা যেত। কিন্তু পুঁথিটি বহু বছর আগে হারিয়ে গেছে, আর ছায়ারা নিশ্চিত করেছে যাতে কেউ সেটি খুঁজে না পায়। পুঁথিটি ছিল ‘অস্তিত্বের আলো’কে একত্রিত করার চাবিকাঠি, যা সমস্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র। কিন্তু এই পুঁথির ব্যবহারকারীকে এক চরম মূল্য দিতে হবে, এমন কিছু যা তার অস্তিত্বকে চিরতরে বদলে দেবে।
“এই সেই হারানো ইতিহাস,” অরুণ বলল, তার চোখে এক নতুন আশার ঝলক, তার মনে এক নতুন সংকল্প। “এই পুঁথিটি কোথায় পাব?”
“পুঁথিটি লুকিয়ে আছে ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরির গভীরে,” আভা বলল, তার কণ্ঠস্বরে একরকম রহস্য। “যেখানে কেউ প্রবেশ করে না, যেখানে পুরোনো দিনের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই গোপন কক্ষেই এটি সুরক্ষিত। এটি এমনভাবে লুকানো যে শুধু সত্যিকারের প্রহরীই এটি খুঁজে পাবে, যার মন পবিত্র এবং বিশ্বাস অটল। এটি একটি যাদুকরী কক্ষ, যা শুধু বিশুদ্ধ আত্মার জন্য উন্মুক্ত, এবং যা ছায়াদের দৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত।”
অরুণ অবাক হয়ে বলল, “আমার লাইব্রেরিতে? কিন্তু আমি তো সব দেখেছি সেখানে। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি তাক আমি চিনি। আমি কীভাবে এটা মিস করলাম? এটা কি কোনো জাদু দ্বারা লুকানো?”
“তুমি হয়তো সব দেখেছ, কিন্তু সব জানো না,” আভা বলল। “লাইব্রেরির ভেতরে এমন একটি গোপন কক্ষ আছে, যা শুধু বিশেষ সময়েই উন্মুক্ত হয়। সেই কক্ষে পুঁথিটি লুকিয়ে আছে। এটি এমনভাবে লুকানো যে শুধু সত্যিকারের প্রহরীই এটি খুঁজে পাবে, যার জ্ঞান আর বিশ্বাস অটল। এটি একটি যাদুকরী কক্ষ, যা শুধু বিশুদ্ধ আত্মার জন্য উন্মুক্ত, এবং যা ছায়াদের দৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত। এর প্রবেশপথও একটি রহস্য দ্বারা আবৃত।”
অরুণ বুঝতে পারল, তার যাত্রা শেষ হয়নি। তাকে আবার তার লাইব্রেরিতে ফিরে যেতে হবে, সেই গোপন কক্ষটি খুঁজে বের করতে হবে, আর প্রাচীন পুঁথিটি উদ্ধার করতে হবে। এই পুঁথিই তাদের শেষ আশা, সমস্ত গল্প আর স্মৃতির অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়। কিন্তু এই পুঁথি ব্যবহারের পরিণতি কী হবে, তা সে জানত না।
“চলো তাহলে,” অরুণ বলল। “আমাদের আর সময় নষ্ট করা যাবে না। ছায়ারা হয়তো আমাদের অনুসরণ করছে, এবং তারা আমাদের থামানোর জন্য যেকোনো কিছু করবে। এই পুঁথি ওদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।”
তারা স্মৃতির গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এল, আর আবার সেই আলোকিত করিডোরে প্রবেশ করল। অরুণ জানত, তার সামনে এক কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। সে তার লাইব্রেরিকে বাঁচাতে চায়, এই বইয়ের জগৎকে বাঁচাতে চায়, এবং সমস্ত গল্পকে ছায়াদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। তার মনে ছিল এক দৃঢ় সংকল্প, যা তাকে অদম্য করে তুলেছিল। তার মনে হলো, এই যাত্রা শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং সমস্ত মানবজাতির জন্য, যারা গল্প আর স্মৃতিকে ভালোবাসে, এবং যারা জ্ঞানের আলোতে বিশ্বাস করে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion