প্রাচীন পুঁথির রহস্য
অরুণ এবং আভা স্মৃতির গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসে আবার সেই করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করল, যা তাদের ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। অরুণের মনে এখন এক নতুন উদ্দেশ্য—প্রাচীন পুঁথিটি খুঁজে বের করা এবং ছায়াদের চিরতরে ধ্বংস করা। করিডোরের বইগুলো যেন তাদের বিদায় জানাচ্ছিল, তাদের শুভকামনা করছিল, তাদের পাতাগুলো মৃদু বাতাসে নড়ছিল, যেন তারা অরুণের বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করছে।
“জ্ঞানদীপ লাইব্রেরির গোপন কক্ষ?” অরুণ আভা-কে প্রশ্ন করল, তার মনে এখনও অবিশ্বাস, তার ভ্রু কুঁচকে ছিল। “আমি তো বহু বছর ধরে এই লাইব্রেরিতে কাজ করছি, কিন্তু এমন কোনো কক্ষের কথা শুনিনি। এটা কি সত্যিই আছে, নাকি এটা শুধু একটি কিংবদন্তি, যা আমাকে বিভ্রান্ত করছে?”
“কারণ এটি সাধারণ কক্ষ নয়,” আভা ব্যাখ্যা করল, তার কণ্ঠস্বরে একরকম দৃঢ়তা। “এটি এমন একটি কক্ষ, যা শুধু বিশেষ সময়েই উন্মুক্ত হয়। যখন বইয়ের জগৎ বিপদে পড়ে, যখন ছায়ারা শক্তিশালী হয়, তখনই এই কক্ষের দরজা খুলে যায়। এটি একটি যাদুকরী কক্ষ, যা জ্ঞানের আলো দিয়ে সুরক্ষিত, এবং শুধুমাত্র সত্যিকারের প্রহরীই এর সন্ধান পায়, যার আত্মা পবিত্র।”
“কিন্তু কখন সেই বিশেষ সময়?” অরুণ প্রশ্ন করল, তার মনে একরকম অস্থিরতা, তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল।
“যখন চাঁদ পূর্ণ হয়, আর তার আলো লাইব্রেরির প্রধান হলঘরের নির্দিষ্ট স্থানে এসে পড়ে,” আভা বলল। “তখনই গোপন কক্ষের দরজা দেখা যায়। এটি একটি প্রাচীন প্রথা, যা জ্ঞানীরা তৈরি করেছিল, যাতে এই পুঁথিটি সুরক্ষিত থাকে, এবং ভুল হাতে না পড়ে।”
অরুণ মনে মনে হিসাব করল। আজ রাতেই পূর্ণিমা। তার মানে, আজ রাতেই সে গোপন কক্ষের সন্ধান পাবে। তার মনে একরকম উত্তেজনা আর ভয় মেশানো অনুভূতি জাগল। সে জানত না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য, কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল যেকোনো কিছুর জন্য, এমনকি তার নিজের অস্তিত্বের বিনিময়েও।
তারা ‘অস্তিত্বের ডায়েরি’র মাধ্যমে আবার ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরির প্রধান হলঘরে ফিরে এল। অরুণ দেখল, লাইব্রেরিটা আগের মতোই নীরব আর অন্ধকার। কিন্তু এখন তার কাছে এই নীরবতার এক নতুন অর্থ ছিল। সে জানত, এই নীরবতার আড়ালে এক অন্য জগৎ লুকিয়ে আছে, এক প্রাচীন রহস্য, যা তার সামনে উন্মোচিত হতে চলেছে, এবং যা তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
অরুণ অপেক্ষা করতে লাগল। বাইরের আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এল, আর চাঁদ আকাশে পূর্ণ রূপে উদয় হলো। চাঁদের আলো লাইব্রেরির বিশাল জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, আর প্রধান হলঘরের মেঝেতে এক উজ্জ্বল বৃত্ত তৈরি করল। আলোটা এতটাই তীব্র ছিল যে লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ আলোকিত হয়ে উঠল, প্রতিটি বইয়ের মলাট থেকে মৃদু দ্যুতি বিচ্ছুরিত হলো, যেন তারা জেগে উঠেছে।
অরুণ বৃত্তের দিকে তাকিয়ে রইল। চাঁদের আলো যখন নির্দিষ্ট স্থানে এসে পড়ল, তখন মেঝেতে একটি পুরোনো, জীর্ণ কার্পেটের নিচে একটি অদ্ভুত নকশা দেখা গেল। নকশাটি ছিল একটি গোলকের, যার চারপাশে অসংখ্য ছোট ছোট বিন্দু ঘুরছে—ঠিক ‘অস্তিত্বের ডায়েরি’র চিত্রের মতো। নকশাটি থেকে একরকম মৃদু আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন এটি জীবন্ত, এবং এটি তাকে ডাকছে।
অরুণ সাবধানে কার্পেটটি সরাল। তার নিচে একটি বিশাল, পাথরের দরজা দেখা গেল। দরজাটি এত মসৃণ ছিল যে তার কোনো ফাটল বা হ্যান্ডেল ছিল না। তার গায়েও কিছু দুর্বোধ্য প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, যা বহু বছর ধরে লুকিয়ে ছিল, এবং যা এক গভীর রহস্য ধারণ করে আছে।
“এটা কীভাবে খুলব?” অরুণ প্রশ্ন করল, তার মনে একরকম সংশয়, তার হাত কাঁপছিল।
“তোমাকে তোমার জ্ঞান দিয়ে এটি খুলতে হবে,” আভা বলল। “এই দরজাটি জ্ঞান দিয়ে সুরক্ষিত। তোমাকে এমন কিছু বলতে হবে, যা এই বইয়ের জগতের মূল শক্তি। এমন একটি বাক্য, যা সমস্ত জ্ঞানকে একত্রিত করে, এবং সমস্ত অন্ধকারকে দূর করে।”
অরুণ চিন্তা করল। জ্ঞান? এই বইয়ের জগতের মূল শক্তি? সে তার মনে থাকা সমস্ত জ্ঞান একত্রিত করল। সে তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত পড়া বইয়ের জ্ঞান, সমস্ত বিশ্বাস একত্রিত করল। তার মনে পড়ল, তার প্রিয় বইগুলোতে লেখা প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি চরিত্র। তারপর সে ধীরে ধীরে, দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করল, তার কণ্ঠস্বর যেন লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, “জ্ঞানই আলো, জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই মুক্তি। জ্ঞানই অস্তিত্বের মূল ভিত্তি, যা সমস্ত অন্ধকারকে জয় করে, এবং সত্যকে উন্মোচন করে।”
তার কথা শেষ হতেই দরজাটি থেকে একটি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি বেরিয়ে এল, আর দরজাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল, এক অদ্ভুত শব্দ করে, যেন কোনো প্রাচীন যন্ত্র জেগে উঠেছে। তার ভেতর থেকে একরকম পুরোনো, ধুলোমাখা গন্ধ বেরিয়ে এল, আর তার সাথে একরকম ঠান্ডা বাতাস। কক্ষের ভেতরে অন্ধকার ছিল, কিন্তু একটি মৃদু আলো দেখা যাচ্ছিল, যা তাদের পথ দেখাচ্ছিল, এবং যা তাদের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করছিল।
অরুণ এবং আভা গোপন কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করল। কক্ষটি ছিল বিশাল, কিন্তু তার ভেতরে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। শুধু মাঝখানে একটি বিশাল, পাথরের বেদীর উপর একটি পুরোনো, জীর্ণ পুঁথি রাখা ছিল। পুঁথিটি থেকে একরকম মৃদু আলো বেরিয়ে আসছিল, যা কক্ষটিকে আলোকিত করে তুলছিল। পুঁথিটির চারপাশে একরকম রহস্যময় আভা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন এটি জীবন্ত, এবং এটি এক গভীর শক্তি ধারণ করে আছে।
“এই সেই প্রাচীন পুঁথি,” আভা বলল, তার কণ্ঠস্বরে একরকম শ্রদ্ধা, তার চোখ পুঁথির উপর নিবদ্ধ। “এর ভেতরেই ছায়াদের দুর্বলতার মূল কারণ লেখা আছে। এটি ‘অস্তিত্বের পুঁথি’ নামে পরিচিত, এবং এটিই আমাদের শেষ আশা, সমস্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র.”
অরুণ সাবধানে পুঁথিটির দিকে এগিয়ে গেল। পুঁথিটি ছিল হাতে লেখা, আর তার ভাষা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি হাজার হাজার বছরের পুরোনো, এবং এর প্রতিটি অক্ষর যেন জ্ঞান আর শক্তি ধারণ করে আছে। অরুণ বহু বছর ধরে পুরোনো পুঁথি নিয়ে কাজ করেছে, তাই সে কিছুটা হলেও এই ভাষা বুঝতে পারছিল। তার মনে হলো, এই পুঁথি যেন তাকে ডাকছে, তাকে তার ভাগ্য সম্পর্কে অবহিত করছে, এবং তাকে এক নতুন দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত করছে।
সে পুঁথিটি খুলল। প্রথম পাতায় একটি চিত্র আঁকা ছিল—একটি ছায়ামূর্তি, যার বুকে একটি উজ্জ্বল আলো প্রবেশ করছে, আর ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন সে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। চিত্রের নিচে কিছু লেখা ছিল, যা অরুণ ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করল। তার চোখ পুঁথির প্রতিটি অক্ষরের উপর নিবদ্ধ ছিল, তার মন সমস্ত জ্ঞানকে শোষণ করছিল, এবং তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল।
পুঁথিতে লেখা ছিল, ছায়ারা আসলে মানুষের ভুলে যাওয়া গল্পের অংশ। যখন কোনো গল্প পুরোপুরি ভুলে যায়, যখন কোনো চরিত্র মানুষের মন থেকে মুছে যায়, তখন তার অস্তিত্বের টুকরোগুলো ছায়ামূর্তি হয়ে যায়। ছায়াদের শক্তি তাদের সংখ্যায়, তাদের অন্ধকারে। কিন্তু তাদের একটি দুর্বলতা আছে—’অস্তিত্বের আলো’। এই আলো হলো সেই গল্পগুলোর মূল শক্তি, যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, যা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, যা মানুষের বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রতীক, যা সমস্ত অন্ধকারকে দূর করে।
পুঁথিতে আরও লেখা ছিল, যদি কোনো মানুষ তার হৃদয়ের সমস্ত জ্ঞান আর বিশ্বাস দিয়ে ‘অস্তিত্বের আলো’কে একত্রিত করতে পারে, তাহলে সে ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু এই আলো একত্রিত করা অত্যন্ত কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন অদম্য সাহস, অবিচল বিশ্বাস, এবং সমস্ত ভয়কে জয় করার ক্ষমতা। পুঁথিটি সতর্ক করে দিয়েছিল যে, এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক, এবং সামান্যতম ভুলের কারণে আলোটি উল্টো ফল দিতে পারে, এমনকি যে এটিকে ব্যবহার করবে তার অস্তিত্বও মুছে যেতে পারে, সে নিজেও ছায়ায় পরিণত হতে পারে। পুঁথির শেষ অংশে একটি অস্পষ্ট চিত্র ছিল, যেখানে একজন মানুষের অবয়ব ধীরে ধীরে আলোতে মিশে যাচ্ছে, যা অরুণের মনে এক গভীর আশঙ্কার সৃষ্টি করল।
অরুণ বুঝতে পারল, তার কাজ শেষ হয়নি। তাকে ‘অস্তিত্বের আলো’কে একত্রিত করতে হবে, আর ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে হবে। তার মনে এক নতুন সংকল্প জন্ম নিল, যা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলল, তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করল, এবং তাকে এক নতুন দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত করল।
“কীভাবে একত্রিত করব এই আলো?” অরুণ প্রশ্ন করল, তার চোখ পুঁথির উপর নিবদ্ধ, তার মনে একরকম অস্থিরতা।
“তোমাকে তোমার হৃদয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পগুলোকে একত্রিত করতে হবে,” আভা বলল। “তোমার জীবনের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত ভালোবাসা—সবকিছুকে একত্রিত করতে হবে। যখন তুমি তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই আলো একত্রিত করবে, তখনই ছায়ারা ধ্বংস হবে। এটি একটি আত্মিক প্রক্রিয়া, যা তোমার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলবে, এবং তোমাকে এই জগতের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু মনে রেখো, এর একটি মূল্য আছে, যা তোমাকে দিতে হবে।”
অরুণ পুঁথিটি হাতে নিল। তার মনে এক নতুন সংকল্প জন্ম নিল। সে তার লাইব্রেরিকে বাঁচাবে, এই বইয়ের জগৎকে বাঁচাবে, এবং সমস্ত গল্পকে ছায়াদের হাত থেকে রক্ষা করবে। সে জানত, তার সামনে এক কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে, এক চূড়ান্ত লড়াই, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, এবং তার অস্তিত্বকে চিরতরে বদলে দেবে। কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। তার হাতে ছিল প্রাচীন জ্ঞান, আর তার পাশে ছিল আভা, তার বিশ্বস্ত সঙ্গী।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion