রশিদ ভাইয়ের আত্মত্যাগের পর শোক করার মতো সময় তাদের ছিল না। তারা জানত, তাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। প্রাণীগুলো একবার রশিদ ভাইয়ের দেহের উপর তাদের নারকীয় উৎসব শেষ করলেই আবার নতুন শিকারের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়বে।
তারা দৌড়ে গিরিখাতের মুখে এসে পৌঁছাল। জায়গাটা দুটো উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে এক সরু, পাথুরে পথ। সূর্যের আলো এখানে প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে। স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার একটা পরিবেশ। আর বাতাসটা ভারী হয়ে আছে একটা পচা, তীব্র গন্ধে।
গিরিখাতের ভেতরে পা রাখতেই তারা বুঝতে পারল এই গন্ধটা কিসের। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাড়গোড়। কিছু মানুষের, কিছু জানোয়ারের। এই জায়গাটা যে দ্বীপের প্রাণীগুলোর খাবার জায়গা বা কসাইখানা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পায়ের নিচে মাটিটা নরম, পিচ্ছিল। যেন রক্ত আর মাংস পচে কাদা হয়ে গেছে।
অরিন্দম ইশারায় সবাইকে থামালেন। "জুতো খুলে ফেলো।"
পাথুরে পথে খালি পায়ে হাঁটা কষ্টকর, কিন্তু জুতোর শব্দ হওয়ার ঝুঁকি তারা নিতে পারবে না। তারা জুতো খুলে হাতে নিল। তারপর এক এক করে গিরিখাতের ভেতরে প্রবেশ করল।
ভেতরের নৈঃশব্দ্যটা বাইরের থেকেও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এখানে বাতাসেরও কোনো শব্দ নেই। কেবল তাদের নিজেদের ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তারা একে অপরের পেছনে, প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে এগোচ্ছিল। প্রত্যেকেই তার সামনের জনের কাঁধে হাত রেখেছিল, যাতে ভারসাম্য না হারায়।
রিয়ার পা একটা নরম কিছুর উপর পড়তেই সে শিউরে উঠল। নিচে তাকিয়ে দেখল, একটা মানুষের মাথার খুলি, কাদায় প্রায় অর্ধেক ডোবানো। হয়তো আগের কোনো দুর্ভাগা অভিযাত্রীর। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
গিরিখাতটা খুব বেশি লম্বা নয়, হয়তো শ'খানেক মিটার। কিন্তু তাদের কাছে রাস্তাটা অনন্ত বলে মনে হচ্ছিল। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তাদের কাছে ছিল এক একটা পরীক্ষা। সোহম ভয়ে কাঁপছিল। বিক্রম তার পাথরের বর্শাটা শক্ত করে ধরে আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখেমুখে এখন ভয়ের বদলে হিংস্র একটা ভাব।
তারা যখন গিরিখাতের প্রায় মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে, ঠিক তখনই সোহমের পা একটা আলগা পাথরে পড়ল। ছোট্ট একটা পাথর গড়িয়ে নিচে পড়ার ক্ষীণ একটা শব্দ হলো। "খট্।"
সবাই সঙ্গে সঙ্গে জমে গেল। হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে এসেছে।
তারা অপেক্ষা করতে লাগল। এক সেকেন্ড... দুই সেকেন্ড... দশ সেকেন্ড...
কোনো শব্দ নেই। কোনো সাড়া নেই।
অরিন্দম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হয়তো প্রাণীগুলো এখনো রশিদ ভাইয়ের আত্মত্যাগের জায়গায় ব্যস্ত, অথবা এই ক্ষীণ শব্দটা তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
তিনি সবাইকে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করলেন। গিরিখাতের শেষ প্রান্তটা আর বেশি দূরে নয়। সেখানে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। মুক্তির আলো।
তারা প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আর মাত্র কয়েক পা।
আর ঠিক তখনই, গিরিখাতের মুখ থেকে, আলোর বিপরীতে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল। লম্বা, সরু, আর মাথায় সেই পরিচিত, চোখবিহীন আকৃতি।
একটা প্রাণী, যা হয়তো দলের সাথে শিকারে যায়নি, অথবা আগেই ফিরে এসেছে। সেটা গিরিখাতের মুখে দাঁড়িয়ে পথ আটকে আছে। স্থির, নিঃশব্দ। যেন তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion