Episode 9424 words3 views

অধ্যায় ৯: রশিদের আত্মত্যাগ

ভোর হওয়ার ঠিক আগে, যখন অন্ধকার সবচাইতে গভীর, তখন তারা নিঃশব্দে প্রস্তুত হলো। রশিদ ভাই সেই অদ্ভুত যন্ত্রটা কোমরে গুঁজে নিলেন। অরিন্দম তার কাঁধে হাত রেখে বিদায় জানালেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু প্রত্যেকের চোখ ছলছল করছে। রশিদ ভাই জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে একবার ঘুরে তাকালেন। তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত শান্ত হাসি। তারপর তিনি ছায়ার মতো এগিয়ে গেলেন। অরিন্দম, রিয়া, বিক্রম আর সোহম অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল চরম উদ্বেগে। এক ঘণ্টা পর তাদের গিরিখাতের দিকে রওনা দেওয়ার কথা। প্রায় চল্লিশ মিনিট কেটে গেছে। জঙ্গলটা আগের মতোই নিস্তব্ধ। অরিন্দমের মনটা কু ডাকছিল। রশিদ ভাইয়ের ফিরতে এত দেরি হওয়ার কথা নয়। আর ঠিক তখনই, যেদিক থেকে রশিদ ভাই গিয়েছিলেন, সেদিক থেকে একটা অস্ফুট যন্ত্রণার শব্দ ভেসে এল। শব্দটা খুবই ক্ষীণ, কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের রাজ্যে তা বজ্রপাতের মতো শোনাল। "চ্যাঁক্!" কীসের শব্দ ছিল ওটা? রশিদ ভাই কি বিপদে পড়েছেন? কিছু বুঝে ওঠার আগেই, জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই পরিচিত, ভয়ঙ্কর খট্ খট্ শব্দটা শুরু হলো। তবে এবার শব্দটা আসছিল সবদিক থেকে। মনে হচ্ছিল, দ্বীপের সমস্ত প্রাণী যেন ওই একটা শব্দের দিকে ছুটে যাচ্ছে। "রশিদ ভাই!" সোহম আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল, কিন্তু বিক্রম তার মুখ চেপে ধরল। অরিন্দমের বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটেছে। রশিদ ভাই হয়তো পা পিছলে বা অন্য কোনোভাবে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন এবং তার মুখ থেকে অসাবধানবশত ওই শব্দটা বেরিয়ে গেছে। আর সেই শব্দই শিকারীদের ডেকে এনেছে। শব্দের ফাঁদ পাতার আগেই, রশিদ ভাই নিজেই টোপ হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলটা কেঁপে উঠল একটা তীব্র, মরিয়া চিৎকারে। এটা রশিদ ভাইয়ের গলার স্বর। তিনি চিৎকার করছেন। কিন্তু তার চিৎকারে ভয় ছিল না, ছিল একটা নির্দেশ। "পালাও! স্যারেরা, তোমরা পালাও!" তিনি ইচ্ছে করে চিৎকার করছেন। তিনি জানতেন, তার বাঁচার কোনো আশা নেই। তাই তিনি নিজের জীবন দিয়ে বাকিদের পালানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন। তার চিৎকারের শব্দ দ্বীপের সমস্ত প্রাণীকে তার দিকে আকৃষ্ট করছে, যাতে অরিন্দমের দলটা নিরাপদে গিরিখাতের দিকে যেতে পারে। রশিদ ভাইয়ের চিৎকারটা হঠাৎ করেই থেমে গেল। তারপর সব আবার আগের মতোই শান্ত। মৃত্যুশীতল শান্ত। দলের প্রত্যেকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তাদের চোখের সামনে দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একজন সাধারণ মাঝি, যিনি কেবল টাকার জন্য তাদের এই দ্বীপে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি তাদের বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন। অরিন্দমের চেতনা ফিরল সবার আগে। তিনি রিয়ার হাত ধরে টান দিলেন। "এখনই সময়। রশিদের আত্মত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।" তার কথায় বাকিদেরও হুঁশ ফিরল। চোখে জল, কিন্তু বুকে প্রতিশোধের আগুন আর বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে তারা গিরিখাতের দিকে দৌড় শুরু করল। তাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ আওয়াজ হচ্ছিল, কিন্তু এখন আর সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই। রশিদ ভাইয়ের শেষ চিৎকারটা এখনো তাদের কানে বাজছে। সেই চিৎকারই এখন তাদের পথপ্রদর্শক।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion