সেই একা দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটা ছিল যেন সাক্ষাৎ যমদূত। তার উপস্থিতিই চারপাশের বাতাসটা বরফের মতো ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল। দলটি যেখানে ছিল, সেখানেই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। নড়ার উপায় নেই, কারণ সামান্য নড়াচড়াই তাদের অবস্থান জানিয়ে দেবে। পালানোরও পথ নেই, কারণ প্রাণীটা তাদের একমাত্র প্রস্থানের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাণীটার মাথাটা ধীরে ধীরে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। সে তার ক্লিকিং সাউন্ড করছিল না। সে শুধু শুনছিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে নৈঃশব্দ্যের ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রাণের স্পন্দন শোনার চেষ্টা করছিল।
সোহম আর পারল না। তার স্নায়ুর বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তার গলা দিয়ে একটা চাপা গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে এল। "উমমম..."
শব্দটা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু এই গিরিখাতের জমাট বাঁধা নৈঃশব্দ্যে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট।
প্রাণীটার মাথাটা সঙ্গে সঙ্গে তাদের দিকে ঘুরে গেল। সে তার শিকারের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে একটা ধারালো, হিসহিস শব্দ বেরিয়ে এল। তারপরই সে লাফ দিল, তার কাস্তের মতো নখরগুলো সামনে বাড়িয়ে।
সবকিছু ঘটল এক মুহূর্তের মধ্যে।
বিক্রম, যে এতদিন ধরে তার ভেতরের সমস্ত রাগ আর হতাশা চেপে রেখেছিল, সে যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। প্রাণীটা লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল।
"আআআআআআআ....!"
বিক্রমের গগনভেদী চিৎকার গিরিখাতের দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সেই চিৎকারে ছিল ভয়, রাগ, হতাশা আর প্রতিশোধের স্পৃহা। এই প্রচণ্ড শব্দটা শুনে প্রাণীটা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। শব্দের এই তীব্রতা হয়তো তার অতি-সংবেদনশীল শ্রবণযন্ত্রে আঘাত করেছিল।
আর এই সুযোগটাই বিক্রম নিল। সে অরিন্দম, রিয়া আর সোহমের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, "তোরা যা! পালা! আমি এটাকে দেখছি!"
কথাটা শেষ করেই সে তার হাতে থাকা ধারালো পাথরের বর্শাটা নিয়ে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রাণীটার উপর। সে ইচ্ছে করে প্রচণ্ড শব্দ করছিল। তার লক্ষ্য ছিল একটাই - প্রাণীটার সমস্ত মনোযোগ নিজের দিকে নিয়ে আসা, যাতে বাকিরা পালানোর সুযোগ পায়।
অরিন্দম হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন, এটা শোক করার সময় নয়। বিক্রম তাদের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে। "রিয়া, সোহম, দৌড়াও!"
রিয়া আর সোহম তখনো ভয়ে অনড়। অরিন্দম তাদের দুজনকে প্রায় টেনেহিঁচড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠার জন্য দৌড় দিলেন।
তারা উপরে উঠতে উঠতে একবার নিচের দিকে তাকাল। সেই দৃশ্য তারা জীবনেও ভুলতে পারবে না।
বিক্রম আর সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা এক মারাত্মক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। বিক্রম তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বর্শাটা দিয়ে প্রাণীটাকে আঘাত করার চেষ্টা করছে, আর প্রাণীটা তার ধারালো নখ দিয়ে বিক্রমকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। বিক্রমের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু তার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, আছে শুধু এক পাশবিক জিদ। তার একটানা চিৎকার আর হুঙ্কার গিরিখাতটাকে নরকে পরিণত করেছে।
তারা পাহাড়ের উপরে ওঠার সময়ও শুনতে পাচ্ছিল বিক্রমের লড়াইয়ের শব্দ। তারপর একটা শেষ, তীব্র চিৎকারের পর সবকিছু আবার শান্ত হয়ে গেল।
গিরিখাতের নৈঃশব্দ্য আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে মিশে আছে বিক্রমের আত্মত্যাগের প্রতিধ্বনি।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion