বিক্রমের আত্মত্যাগ তাদের তিনজনকেই পাহাড়ের চূড়ার দিকে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল। তারা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে, হাঁপাতে হাঁপাতে পাথুরে ঢাল বেয়ে উপরে উঠছিল। তাদের শরীর ক্লান্ত, মন বিধ্বস্ত। রশিদ ভাই আর বিক্রমের মৃত্যু তাদের ভেতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন থেমে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
অবশেষে, তারা পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে এসে পৌঁছাল। জায়গাটা বেশ কিছুটা খোলা, পাথর আর কিছু কাঁটাঝোঁপ ছাড়া আর কিছু নেই। এখান থেকে পুরো দ্বীপটা এবং চারপাশের অনন্ত সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম তারা দ্বীপের claustrophobic (দমবন্ধ করা) জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এতখানি খোলা জায়গা দেখতে পেল।
কিন্তু তাদের স্বস্তি পাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তারা নিচে গিরিখাতের দিকে তাকাল। কোনো নড়াচড়া নেই। বিক্রম বা সেই প্রাণীটা, কারো কোনো চিহ্ন নেই। সবকিছু শান্ত। কিন্তু তারা জানত, এই শান্তি সাময়িক।
"আমাদের সিগন্যাল তৈরি করতে হবে," অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।
সোহম তার ব্যাগ থেকে অবশিষ্ট যন্ত্রাংশগুলো বের করল। একটা ভাঙা ক্যামেরার লেন্স, রোদ-চশমার কাঁচ, আর তার জলের বোতলের চকচকে ধাতব নিচের অংশটা। তার কাছে আগুন জ্বালানোর মতো কিছু ছিল না, তাই ধোঁয়া দিয়ে সংকেত পাঠানোর উপায় নেই। একমাত্র ভরসা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে কোনো জাহাজ বা বিমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
কিন্তু আকাশ মেঘলা। সূর্যের দেখা নেই।
"আমাদের অপেক্ষা করতে হবে," রিয়া বলল। তার গলাটা কান্নায় ধরে আসছিল। "আমাদের শুধু অপেক্ষা করতে হবে।"
তারা তিনজন চূড়ার একটা পাথরের আড়ালে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। সময় যেন কাটতেই চাইছিল না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত তাদের কাছে অনন্ত বলে মনে হচ্ছিল। নিচে থেকে কোনো শব্দ নেই। প্রাণীগুলো কি গিরিখাত ছেড়ে চলে গেছে? নাকি তারা পাহাড়ের নিচে এসে জড়ো হচ্ছে, উপরে ওঠার পথের সন্ধান করছে?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। মেঘ সরার কোনো লক্ষণ নেই। তাদের আশা ধীরে ধীরে হতাশায় পরিণত হচ্ছিল। সোহম তার বানানো ছোট্ট রিফ্লেক্টরটা হাতে নিয়ে বসেছিল, তার চোখ দুটো শূন্য। রিয়া দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু দিগন্তে কোনো জাহাজের চিহ্নও নেই।
অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ। রশিদ আর বিক্রমের আত্মত্যাগ কি বৃথা যাবে? তারা কি এখানেই অনাহারে বা ওই ভয়ঙ্কর প্রাণীদের শিকারে পরিণত হয়ে মারা যাবে?
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম। পশ্চিম আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের ক্ষীণ আলো দেখা গেল।
"সোহম!" অরিন্দম প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে গলা নামিয়ে নিলেন।
সোহম চমকে উঠল। সে দেখল, সূর্যের আলো মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। এটাই হয়তো তাদের শেষ সুযোগ।
সে তার রিফ্লেক্টরটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাঁপতে কাঁপতে সে সূর্যের দিকে যন্ত্রটা ধরল, যাতে আলোটা প্রতিফলিত হয়ে সমুদ্রের দিকে যায়। সে দিগন্ত বরাবর আলোর বিন্দুটাকে ঘোরাতে লাগল, একটা মরিয়া চেষ্টায়, যদি কারো চোখে পড়ে।
অরিন্দম আর রিয়াও তার পাশে এসে দাঁড়াল। তারা তিনজন মিলে তাকিয়ে রইল দিগন্তের দিকে, একটা ক্ষীণ আশাকে আঁকড়ে ধরে। তাদের জীবন এখন নির্ভর করছে ওই ছোট্ট আলোর বিন্দুর উপর।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion