কোস্ট গার্ডের বোটটা দ্বীপের কাছাকাছি এসে তার গতি কমিয়ে দিল। তারা লাউডস্পিকারে ঘোষণা করল, "উপরে যারা আছো, তোমরা চিন্তা কোরো না। আমরা তোমাদের উদ্ধার করতে আসছি।"
কিন্তু উদ্ধারকাজটা যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততটা সহজ ছিল না। পাহাড়ের চূড়াটা সমতল নয়, তাই হেলিকপ্টার নামার কোনো জায়গা নেই। বোট থেকে একটা ছোট ডিঙি নামিয়ে উদ্ধারকারীদের আসতে হবে।
ইতিমধ্যে, পাহাড়ের নিচ থেকে ভেসে আসা খট্ খট্ আর হিসহিসানির শব্দ বেড়েই চলেছিল। প্রাণীগুলো বোটের ইঞ্জিনের শব্দে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। তারা পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছিল, কিন্তু খাড়া ঢালের জন্য পারছিল না। তাদের ব্যর্থ আক্রোশের চিৎকার পরিবেশটাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল।
দুজন উদ্ধারকারী ডিঙি নিয়ে তীরে এসে নামল। তারা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল। "নিচে ওগুলো কীসের আওয়াজ?" একজন ওয়াকিটকিতে তার অফিসারকে জিজ্ঞেস করল।
অরিন্দম উপর থেকে চিৎকার করে বললেন, "উপরে চলে আসুন! তাড়াতাড়ি! নিচে নামার চেষ্টা করবেন না!"
উদ্ধারকারীরা দড়ি আর অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করল। কাজটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নিচে শয়ে শয়ে ক্ষুধার্ত প্রাণী অপেক্ষা করছে।
অবশেষে, তারা উপরে পৌঁছাল। অরিন্দম, রিয়া আর সোহমের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তারা চমকে গেল। "আপনাদের বাকি সঙ্গীরা কোথায়?" একজন জিজ্ঞেস করল।
"তারা আর নেই," অরিন্দম কেবল এটুকুই বলতে পারলেন।
তাদেরকে দড়ির সাহায্যে সাবধানে নিচে নামানো হলো। পুরো সময়টা জুড়ে নিচ থেকে ভেসে আসছিল সেই নারকীয় কোলাহল। ডিঙিতে ওঠার সময় রিয়া একবার পেছনে ফিরে তাকাল। সে দেখল, অসংখ্য ফ্যাকাশে, চোখবিহীন প্রাণী পাহাড়ের গোড়ায় ছোটাছুটি করছে, তাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আক্রোশে। দৃশ্যটা তার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গেল।
অবশেষে তারা মূল বোটে এসে পৌঁছাল। নিরাপদ। মুক্ত।
বোটের মেডিক্যাল অফিসার তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। তাদের শরীরে অসংখ্য ছোটখাটো আঘাত, কিন্তু সবচাইতে বড় আঘাতটা তাদের মনে। তারা তিনজনই চুপ করে বসেছিল, যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
কোস্ট গার্ডের ক্যাপ্টেন অরিন্দমের কাছে এসে ঘটনার বিবরণ চাইলেন। অরিন্দম কী বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না। সত্যি কথা বললে কেউ কি বিশ্বাস করবে? তাকে কি পাগল ভাববে?
কিন্তু তিনি জানতেন, তাকে সত্যিটাই বলতে হবে। যদি এই দ্বীপের কথা অজানা থেকে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ যেতে পারে।
তিনি ক্যাপ্টেনকে সবটা খুলে বললেন। ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্বীপে আটকা পড়া থেকে শুরু করে শব্দ-সংবেদনশীল, ভয়ঙ্কর প্রাণীদের কথা, রশিদ ভাই আর বিক্রমের আত্মত্যাগের কাহিনী - সবকিছু।
ক্যাপ্টেন চুপ করে তার কথা শুনলেন। তার মুখে অবিশ্বাস এর ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু অরিন্দমের চোখের দিকে তাকিয়ে, তাদের তিনজনের আতঙ্কিত অবস্থা দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন, তারা যা বলছে, তা বানিয়ে বলা নয়।
অরিন্দম বোটের চার্ট চেয়ে দ্বীপটার অবস্থান চিহ্নিত করলেন। "আমি অনুরোধ করছি, এই দ্বীপটাকে আপনারা 'নো-গো জোন' হিসেবে ঘোষণা করুন। এটাকে বায়োলজিক্যাল হ্যাজার্ড হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। এখানে সাধারণ মানুষের আসা মানে নিশ্চিত মৃত্যু।"
ক্যাপ্টেন কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না, কিন্তু তিনি অরিন্দমের কথাগুলো গুরুত্বের সাথে নোট করলেন। "আমরা উপরে রিপোর্ট করব। বাকিটা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।"
বোটটা সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলল। পেছনে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল সেই অভিশপ্ত দ্বীপ। দ্বীপটা আবার তার আদিম নৈঃশব্দ্যে ঢেকে যাচ্ছিল। কিন্তু অরিন্দম, রিয়া আর সোহমের মনে সেই নৈঃশব্দ্যের আতঙ্ক চিরকালের জন্য রয়ে গেল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion