Episode 3422 words3 views

অধ্যায় ৩: প্রথম রাত্রি

রাত বাড়ার সাথে সাথে দ্বীপের নৈঃশব্দ্য যেন আরও বেশি করে চেপে বসতে লাগল। চারজনের দলটা তাদের অস্থায়ী আশ্রয়ের নিচে huddled (জড়সড়) হয়ে বসেছিল। ঘুম কারোরই চোখে ছিল না। অজানা ভয় আর ঠাণ্ডা হাওয়া তাদের সজাগ করে রেখেছিল। হঠাৎ, জঙ্গলের গভীর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। খুব ক্ষীণ, কিন্তু স্পষ্ট। খট্...খট্...খট্...। অনেকটা শুকনো ডালে ঠোকর দেওয়ার মতো, কিন্তু যান্ত্রিক আর নিয়মিত ছন্দে। শব্দটা শুনে সবাই চমকে উঠল। এই নৈঃশব্দ্যের রাজ্যে যেকোনো নতুন শব্দই ছিল একাধারে কৌতূহল এবং আতঙ্কের উৎস। সোহম ফিসফিস করে বলল, "কীসের আওয়াজ ওটা?" অরিন্দম ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বললেন। তারা কান খাড়া করে রইল। শব্দটা কয়েক মুহূর্ত স্থায়ী হয়ে আবার মিলিয়ে গেল। বিক্রম তার হাতে একটা বড় কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসল। পরিবেশটা আবার আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এবার সেই নৈঃশব্দ্যের গভীরে একটা অজানা আতঙ্ক মিশে রইল। যেন কিছু একটা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। রাত প্রায় দুটো হবে। সবাই ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েছে। সোহমের হাত থেকে তার স্টিলের জলের বোতলটা ফসকে গিয়ে একটা পাথরের উপর পড়ল। "ক্ল্যাং!" ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু এই জমাট বাঁধা নৈঃশব্দ্যের রাজ্যে সেই শব্দটা যেন কামানের গোলার মতো শোনাল। সবাই ধড়মড়িয়ে উঠল। অরিন্দম রেগে গিয়ে সোহমের দিকে তাকাতে গিয়েও থেমে গেলেন। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। যেদিক থেকে খট্ খট্ শব্দটা আসছিল, সেদিক থেকে হঠাৎ করেই যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। গাছপালার মধ্যে দিয়ে কিছু একটা অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে আসার শব্দ হলো। যেন কোনো দানবীয় প্রাণী জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে আসছে। তারপরই শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ, রক্ত জল করে দেওয়া চিৎকার! কিন্তু চিৎকারটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই যেন কেউ গলা টিপে থামিয়ে দিল। একটা তীব্র যন্ত্রণার আর্তনাদ শুরু হয়েই মাঝপথে থেমে গেল, যা না শোনার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু আবার শান্ত। কিন্তু এই শান্তিটা মৃত্যুর শান্তির মতো শীতল। দলের প্রত্যেকে ভয়ে জমে গেছে। তাদের নিঃশ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে গেছে। কী ছিল ওটা? কীসের চিৎকার ছিল? আর কেনই বা থেমে গেল? বিক্রম কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "ওটা... ওটা কোনো জানোয়ারের ডাক ছিল। মনে হলো কেউ ওটাকে শিকার করল।" "কিন্তু শিকার করল কে?" রিয়া প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল। এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে ছিল না। তারা বুঝতে পারল, এই দ্বীপে তারা একা নয়। এই নৈঃশব্দ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু একটা। কিছু একটা ভয়ঙ্কর, দ্রুত এবং শক্তিশালী। আর কিছু একটা, যা শব্দের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সোহমের হাত থেকে বোতল পড়ার শব্দই কি সেই শিকারীকে ডেকে এনেছিল? ভাবতে গিয়ে সকলের শরীর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। তারা বাকি রাতটা এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারল না। প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিল, এই দ্বীপে তাদের সবচাইতে বড় ভুল হবে কোনো শব্দ করা। এখানে নৈঃশব্দ্যই হলো বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion