ভোরের আলো ফুটতেই গত রাতের আতঙ্কটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। কেউ কারো সাথে কথা বলছিল না। ভয়টা প্রত্যেকের চোখেমুখে জমে রয়েছে।
অরিন্দমই প্রথম নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন, তবে খুব নিচু গলায়। "আমাদের দেখতে হবে রাতে ঠিক কী হয়েছিল।"
বিক্রম সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। "আমিও তাই বলছি। বসে বসে ভয় পাওয়ার চেয়ে জানা ভালো আমাদের শত্রুটা কে।"
রশিদ ভাই তাদের মানা করলেন। "ভিতরে যাওয়ার দরকার নাই, স্যার। যা শুনছেন, তারপরও..."
কিন্তু অরিন্দম আর বিক্রম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। তারা রশিদ ভাইয়ের কাছ থেকে তার ছোট কিন্তু ধারালো শিকারের ছুরিটা নিল। রিয়া আর সোহমকে শিবিরে থাকতে বলে তারা দুজন খুব সাবধানে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। যেদিক থেকে রাতেরবেলায় সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা এসেছিল, সেদিকে।
জঙ্গলটা দিনের বেলাতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। বড় বড় গাছের পাতা ভেদ করে সূর্যের আলো প্রায় ঢুকতেই পারছে না। মাটিটা স্যাঁতস্যাঁতে। অরিন্দম আর বিক্রম পা টিপে টিপে এগোচ্ছিল, শুকনো পাতা বা ডালপালা এড়িয়ে।
কিছুটা ভেতরে যাওয়ার পর, তারা জিনিসটা দেখতে পেল। একটা বড় গাছের গায়ে গভীর আঁচড়ের দাগ। যেন ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে কেউ গাছের ছালটা চেঁছে নিয়েছে। বিক্রম কাছে গিয়ে দাগগুলো পরীক্ষা করল। "তিনটে করে দাগ। খুব গভীর। যা দিয়েই আঁচড়টা কাটা হোক, জিনিসটা খুব শক্তিশালী।"
তারা আরও কিছুটা এগোতেই একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছাল। আর সেখানকার দৃশ্য দেখে তাদের রক্ত জমে গেল।
মাটিতে পড়ে আছে একটা চিত্রা হরিণের ছিন্নভিন্ন দেহ। শরীরটা যেন কেউ নৃশংসভাবে ছিঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, আশেপাশে রক্তের দাগ প্রায় নেই বললেই চলে। যেন শিকারী খুব নিখুঁতভাবে শিকার করেছে। হরিণটা এই দ্বীপে এল কী করে? হয়তো ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভেসে এসেছিল।
অরিন্দম ঝুঁকে পড়ে হরিণটার ক্ষতগুলো পরীক্ষা করলেন। "এরকম জখম আমি আগে কখনো দেখিনি। কোনো বাঘ বা অন্য কোনো পরিচিত শিকারী প্রাণীর কাজ এটা নয়। দাঁতের দাগের চেয়েও ধারালো কিছুর চিহ্ন রয়েছে। যেন সার্জনের ছুরি দিয়ে কাটা।"
বিক্রম একটু দূরে মাটিতে কিছু একটা চকচক করতে দেখল। কাছে গিয়ে তুলে আনতেই সে চমকে উঠল। এটা রশিদ ভাইয়ের ছুরি, যেটা সে কাল রাতে বিক্রমকে দিয়েছিল। কিন্তু ছুরিটার এখন যা অবস্থা! স্টিলের মজবুত ফলাটা এমনভাবে বেঁকে দুমড়ে গেছে, যেন কেউ প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ওটাকে পিষে দিয়েছে।
"অসম্ভব!" বিক্রমের গলা দিয়ে incredulous (অবিশ্বাসী) স্বর বেরিয়ে এল। "এটা কী করে সম্ভব?"
অরিন্দম আর বিক্রমের বুঝতে বাকি রইল না। রাতে বোতল পড়ার শব্দ শুনে যে প্রাণীটা এসেছিল, এটা তারই কাজ। হরিণটা হয়তো কাছাকাছিই ছিল, আর তার সামান্য নড়াচড়ার শব্দেই সে প্রাণীটার শিকার হয়ে গেছে। আর রশিদ ভাইয়ের ছুরিটা? হয়তো হরিণের দেহ থেকে ওটা ছিটকে পড়েছিল আর সেই প্রাণীটা ওটাকে মাটির সাথে পিষে দিয়ে গেছে।
তারা দুজন আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। নিঃশব্দে, প্রায় ছুটে তারা শিবিরে ফিরে এল। তাদের ফ্যাকাশে মুখ আর আতঙ্কিত চোখ দেখেই রিয়া আর সোহম বুঝে গেল যে তারা ভয়ঙ্কর কিছু একটা দেখে এসেছে।
অরিন্দম সবাইকে এক জায়গায় বসালেন। ফিসফিস করে, যতটা সম্ভব নিচু গলায় তিনি পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলেন। তার কথা শেষ হওয়ার পর শিবিরে যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এল।
"তাহলে... তাহলে আমাদের অনুমানই ঠিক," রিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। "এই দ্বীপের শিকারীরা শব্দের সাহায্যে শিকার করে।"
অরিন্দম মাথা নাড়লেন। "হ্যাঁ। ওদের শ্রবণশক্তি অবিশ্বাস্য রকমের প্রখর। হয়তো ওরা চোখে দেখতে পায় না, বা ওদের দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল। তাই ওরা শব্দের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কাল রাতে বোতলের শব্দে ওরা আকৃষ্ট হয়েছিল, আর কাছাকাছি থাকা হরিণটা সামান্য নড়াচড়া করতেই..."
কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না। কিন্তু প্রত্যেকেই বুঝে গেল বাকিটা।
সোহম ভয়ে প্রায় কাঁদতে শুরু করল। "তার মানে... তার মানে আমাদের একটুও শব্দ না করে থাকতে হবে? কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? হাঁচি, কাশি, কথা বলা..."
"আমাদের পারতেই হবে, সোহম," অরিন্দম দৃঢ় গলায় বললেন। "যদি আমরা বাঁচতে চাই, তাহলে এই দ্বীপের নিয়ম আমাদের মানতে হবে। আজ থেকে, এই দ্বীপের নতুন নিয়ম হলো—নৈঃশব্দ্য।"
সেই মুহূর্ত থেকে তাদের জীবনযাত্রাই বদলে গেল। তারা ইশারায় কথা বলতে শুরু করল। হাঁটাচলা করতে লাগল পা টিপে টিপে, যেন মাটির উপরে তুলো বিছানো আছে। খাওয়া, ঘুম, জল আনা—সবকিছু হতে লাগল নিঃশব্দে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন এক একটা পরীক্ষা। কারণ তারা জেনে গেছে, একটা ছোট্ট ভুল, একটা অসাবধান শব্দই ডেকে আনতে পারে এক নৃশংস, দ্রুত এবং অদৃশ্য মৃত্যুকে। তারা এখন আর গবেষক নয়, তারা এখন শিকার। আর শিকারী লুকিয়ে আছে এই দ্বীপের জমাট বাঁধা নৈঃশব্দ্যের আড়ালে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion