Episode 5583 words3 views

অধ্যায় ৫: নৈঃশব্দ্যের নিয়ম

দিনগুলো দুঃস্বপ্নের মতো কাটতে লাগল। কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দলের মধ্যে এক অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলো। প্রত্যেকে নিজের চিন্তায় মগ্ন, নিজের ভয়ে আতঙ্কিত। ইশারার মাধ্যমে কেবল জরুরি তথ্যই আদান-প্রদান করা সম্ভব, কিন্তু মনের ভাব, ভয় বা সান্ত্বনা—এগুলো প্রকাশ করার কোনো উপায় ছিল না। অরিন্দম একটি নতুন নিয়ম তৈরি করলেন। তারা সকলে মিলে কিছু সাধারণ কিন্তু জরুরি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সাংকেতিক ভাষা তৈরি করল। হাত দিয়ে জলের ইশারা, পেটে হাত দিয়ে ক্ষুধার ইশারা, বা জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে বিপদের সঙ্কেত। এই মূকাভিনয়ই হয়ে উঠল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সবচেয়ে কঠিন ছিল দৈনন্দিন কাজগুলো নিঃশব্দে করা। জল আনতে গেলে পাত্র ভরার শব্দ, শুকনো কাঠ ভাঙার মটমট আওয়াজ, এমনকি হাঁটার সময় পায়ের নিচের শুকনো পাতার খসখস শব্দ—সবকিছুই এখন সম্ভাব্য মৃত্যুর পরোয়ানা। তারা কাপড় ছিঁড়ে পায়ের তলায় জড়িয়ে নিল, যাতে হাঁটার শব্দ কম হয়। খাওয়ার সময়ও তারা খুব সাবধানে শুকনো খাবার মুখে দিত, যাতে চিবানোর শব্দ যতটা সম্ভব কম হয়। এই নৈঃশব্দ্যের জীবনযাত্রা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে শুরু করল। সোহম সারাক্ষণ ভয়ে সিটিয়ে থাকত। রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠত, কিন্তু চিৎকার করার ভয়ে মুখ চেপে ধরে রাখত। তার চোখ দুটো সবসময় কোটরের মধ্যে ঢোকানো থাকত। বিক্রমের মতো শক্তিশালী মানুষও ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল। তার প্রকৃতি ছিল কাজ করা, লড়াই করা। কিন্তু এখানে লড়াই করার কোনো উপায় নেই। শত্রুকে দেখা যায় না, কেবল তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। এই নিষ্ক্রিয়তা, এই অসহায়ত্ব তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সে প্রায়ই রাগে, হতাশায় তার হাতের মুঠি শক্ত করে ধরত, কিন্তু শব্দ করার ভয়ে দেয়ালে একটা ঘুষিও মারতে পারত না। রিয়া নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সে তার উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিঃশব্দে খাবারযোগ্য কিছু লতাপাতা বা মূল খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। সে লক্ষ্য করল, দ্বীপের কিছু গাছের পাতা খুব নরম এবং পুরু। সে সেই পাতাগুলো সংগ্রহ করে তাদের আশ্রয়ের নিচে বিছিয়ে দিল, যাতে তাদের নড়াচড়ার শব্দ কম হয়। তার পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল প্রবল। সে-ই প্রথম লক্ষ্য করল যে, ওই ভয়ঙ্কর খট্ খট্ শব্দটা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় বেশি শোনা যায়, যখন আবহাওয়া শান্ত থাকে। একদিন দুপুরে, যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে বসে আছে, তখন একটা unexpected (অপ্রত্যাশিত) ঘটনা ঘটল। অরিন্দমের হঠাৎ করে প্রচণ্ড হাঁচি পেল। তিনি প্রাণপণে মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। একটা চাপা "হ্যাঁচ্চো" শব্দ বেরিয়ে এল। শব্দটা খুব জোরালো ছিল না, কিন্তু এই মৃত্যুপুরীতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই পরিচিত খট্ খট্ শব্দটা ভেসে এল। এবার অনেক কাছ থেকে। দলের প্রত্যেকে পাথরের মতো জমে গেল। তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ। অরিন্দম নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং আতঙ্কিত। তিনি বুঝতে পারছিলেন, শব্দটা তার দিক থেকেই এসেছে, তাই বিপদটা তারই সবচাইতে বেশি। খট্ খট্ শব্দটা তাদের শিবিরের খুব কাছে এসে থেমে গেল। তারা সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে, নড়াচড়া না করে বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত, যা অনন্তকালের মতো মনে হচ্ছিল, কেটে গেল। তারপর তারা অনুভব করল, কিছু একটা তাদের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। তারা সাহস করে তাকানোর চেষ্টা করল না। কেবল একটা অদ্ভুত, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগল। কিছুক্ষণ পর খট্ খট্ শব্দটা ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। বিপদ কেটে গেছে। অরিন্দম ঘামে ভিজে গিয়েছিলেন। তিনি ইশারায় বাকিদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এই ঘটনাটা তাদের শিখিয়ে দিল যে, শরীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোও এখানে কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কাশি, হাঁচি, এমনকি জোরে শ্বাস ফেলারও কোনো উপায় নেই। তাদের জীবনটা হয়ে উঠল এক জীবন্ত নরক। যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হচ্ছে চূড়ান্ত সতর্কতার সাথে। তাদের মন আর স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। তারা জানত, এভাবে বেশিদিন চলবে না। মানুষ যন্ত্র নয়। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন না একদিন, কেউ না কেউ ভুল করবেই। আর সেই দিনটাই হবে এই দ্বীপে তাদের শেষ দিন।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion