Episode 6584 words3 views

অধ্যায় ৬: অল্পের জন্য রক্ষা

দিন যত গড়াচ্ছিল, সোহমের মানসিক অবস্থা তত খারাপ হচ্ছিল। সে তার ভাঙা রেডিওর যন্ত্রাংশগুলো নিয়ে সারাদিন বসে থাকত, একটা ক্ষীণ আশায় যে যদি কোনোভাবে একটা এমার্জেন্সি সিগন্যাল তৈরি করা যায়। তার মনে হচ্ছিল, এই কাজটাই তাকে পাগল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একদিন বিকেলে, সোহম তার যন্ত্রপাতির ছোট বাক্সটা নিয়ে কাজ করছিল। তার হাত ভয়ে আর অনাহারে কাঁপছিল। অসাবধানবশত, তার হাত থেকে একটা ছোট স্ক্রুড্রাইভার বাক্সের গায়ে পড়ে গেল। "টং!" ধাতব শব্দটা আগের দিনের হাঁচির চেয়েও অনেক বেশি তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্ট ছিল। সোহমের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে застыл ( জমে গেল), তার চোখ দুটো বিস্ফারিত। এবার আর কোনো ভুল ছিল না। জঙ্গলের ভেতর থেকে খট্ খট্ শব্দটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো এবং অবিশ্বাস্য গতিতে তাদের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। এবার শব্দটা একটা নয়, মনে হচ্ছিল বেশ কয়েকটা প্রাণী একসাথে আসছে। "মাটির সাথে মিশে যাও!" অরিন্দম প্রায় নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে বললেন। তারা প্রত্যেকে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, মুখ বালিতে গোঁজা। হৃৎপিণ্ডটা এমনভাবে ধুকপুক করছিল যে সোহমের মনে হচ্ছিল, এই শব্দের জোরেই হয়তো প্রাণীগুলো তাদের খুঁজে পাবে। শব্দটা একেবারে তাদের শিবিরের প্রান্তে এসে থেমে গেল। তারপর তারা যা দেখল, তা তাদের জীবনের সবচাইতে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। তাদের থেকে মাত্র দশ-বারো ফুট দূরে, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রাণীটা। না, একটা নয়, তিন-তিনটে। প্রাণীগুলোর চেহারা অনেকটা সরীসৃপের মতো, কিন্তু তাদের চামড়া ফ্যাকাশে সাদা, প্রায় স্বচ্ছ। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। সরু, লম্বা হাত-পা। কিন্তু সবচাইতে ভয়ঙ্কর তাদের মাথাটা। মাথার জায়গায় চোখ থাকার কোনো চিহ্ন নেই। পুরো মুখটাই মসৃণ, কেবল মাঝখানে একটা গহ্বরের মতো নাক আর তার নিচে ধারালো দাঁতের সারি। তাদের বিশাল আকারের মাথাটা অনেকটা বাদুড়ের মতো এদিক-ওদিক ঘুরছিল, যেন শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। আর তাদের হাতের শেষে আঙুলের বদলে রয়েছে তিনটি করে লম্বা, কাস্তের মতো বাঁকানো নখর, যা দিয়ে তারা সহজেই গাছের ছাল বা হরিণের শরীর চিরে ফেলতে পারে। আর ওই খট্ খট্ শব্দটা? ওটা আসছিল তাদের গলা থেকে। তারা এক ধরনের ক্লিকিং সাউন্ড করছিল, অনেকটা ডলফিনের ইকোলোকেশন সিস্টেমের মতো। এই শব্দতরঙ্গ আশেপাশের বস্তুতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল এবং তা থেকেই তারা নিজেদের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করছিল। প্রাণীগুলো কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের মাথাগুলো ঘুরছিল, চারপাশের নৈঃশব্দ্যটাকে যেন বিশ্লেষণ করছিল। গবেষক দলের সদস্যরা এক চুলও নড়ল না। তাদের মনে হচ্ছিল যেন সময় থেমে গেছে। একটা প্রাণী কয়েক পা এগিয়ে এল। সেটা সোহমের খুব কাছে চলে এসেছিল। সোহম তার স্যাঁতস্যাঁতে, পচা মাংসের মতো গন্ধটা পাচ্ছিল। সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি শেষ। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, সৈকতের অন্য প্রান্ত থেকে, কিছুটা দূরে, সমুদ্রের একটা বড় ঢেউ সজোরে এসে পাথরের উপর আছড়ে পড়ল। "খ্যাঁশ্!" জলের শব্দটা তুলনামূলকভাবে অনেক জোরালো ছিল। আর সেই শব্দটা শুনেই প্রাণীগুলো সেদিকে ঘুরে গেল। তাদের কাছে হয়তো ঢেউয়ের শব্দটা আরও আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তারা কয়েক মুহূর্ত সেদিকে "কান" পেতে রইল, তারপর নিঃশব্দে, ছায়ার মতো জঙ্গলের গভীরে মিলিয়ে গেল। বিপদ কেটে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ কেউ নড়ার সাহস পেল না। যখন তারা finalmente (অবশেষে) মুখ তুলল, প্রত্যেকের চোখে ছিল অপার বিস্ময় এবং আতঙ্ক। তারা এই প্রথম তাদের শত্রুকে চাক্ষুষ দেখল। এই প্রাণীগুলো পৃথিবীর কোনো পরিচিত জীবজগতের অংশ নয়। এরা এই দ্বীপের পরিবেশে বেড়ে ওঠা এক বিবর্তনের ফসল। এক ভয়ঙ্কর, নিখুঁত শিকারী। এই ঘটনাটার পর দলের মধ্যেকার উত্তেজনা চরমে পৌঁছাল। বিক্রম আর চুপ করে থাকতে পারছিল না। সে ইশারায় অরিন্দমকে বোঝানোর চেষ্টা করল, "আর লুকিয়ে থাকা নয়। আমাদের অস্ত্র তৈরি করতে হবে। লড়াই করতে হবে।" অরিন্দম মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন। তিনি ইশারায় বোঝালেন, "ওদের সাথে লড়াই করে জেতা অসম্ভব। আমাদের পালানোর পথ খুঁজতে হবে।" দলের মধ্যে প্রথমবার বিভেদের জন্ম হলো। একদিকে বিক্রমের লড়াই করার জেদ, আর অন্যদিকে অরিন্দমের পালানোর পরিকল্পনা। তারা জানত না, তাদের এই মতবিরোধই ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion