সময় বয়ে যাচ্ছিল। এক সপ্তাহ কেটে গেছে। খাদ্যের ভাণ্ডার প্রায় শেষ। অনাহার, ভয় আর মানসিক চাপে দলের প্রত্যেকের চেহারা ভেঙে গেছে। তাদের মধ্যেকার নীরব কথোপকথন এখন মূলত বিরক্তি আর হতাশায় পূর্ণ।
বিক্রমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। সে অরিন্দমের অতি-সতর্কতাকে কাপুরুষতা বলে মনে করতে শুরু করেছিল। তার মতে, এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। সে দিনের বেশিরভাগ সময় সৈকতের ধারে বসে পাথর ঘষে ঘষে ধারালো করার চেষ্টা করত। তার লক্ষ্য ছিল একটা কাজ চালানোর মতো বর্শা বা ছুরি তৈরি করা। অরিন্দম তাকে বারবার ইশারায় বারণ করতেন, কারণ পাথর ঘষার শব্দও বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু বিক্রম কারো কথা শোনার মতো অবস্থায় ছিল না।
একদিন সকালে, রিয়া জঙ্গলের ভেতর থেকে কিছু নরম গাছের ছাল নিয়ে এল। সে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল যে, এই ছালগুলো দড়ির মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ছালগুলো ছাড়ানোর সময় তার হাতে এক ধরনের আঠালো, ঘন রস লেগে গিয়েছিল। রসটা খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাচ্ছিল এবং শুকানোর পর বেশ শক্ত হয়ে যাচ্ছিল।
রিয়ার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে ইশারায় অরিন্দমকে ব্যাপারটা বোঝাল। এই আঠা দিয়ে হয়তো ছোট ছোট পাথর কাঠের ডালের মাথায় লাগিয়ে বর্শার ফলা তৈরি করা সম্ভব। অরিন্দমের পরিকল্পনা অন্যরকম হলেও, আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন তিনিও অনুভব করছিলেন। তাই তিনি সম্মতি দিলেন।
শুরু হলো নিঃশব্দে অস্ত্র তৈরির কাজ। বিক্রমের উৎসাহই ছিল সবচাইতে বেশি। সে দ্বিগুণ উদ্যমে পাথর ধারালো করতে লাগল। সোহমও এই কাজে যোগ দিল। তার মনে হচ্ছিল, হাতে একটা অস্ত্র থাকলে হয়তো ভয়টা কিছুটা কমবে।
কিন্তু তাদের এই কাজ বিপদ ডেকে আনতে খুব বেশি দেরি করল না। বিক্রম একটা বড় পাথর দিয়ে অন্য একটা চ্যাপ্টা পাথরে আঘাত করে সেটার ধার পরীক্ষা করছিল। শব্দটা খুব বেশি জোরালো না হলেও, যথেষ্ট ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ, হিসহিসানির মতো শব্দ ভেসে এল। কোনো ক্লিকিং সাউন্ড নয়, অন্যরকম একটা আওয়াজ। যেন কোনো সংকেত।
অরিন্দম সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। তারা কান খাড়া করে রইল। কিন্তু আর কোনো শব্দ হলো না। পরিবেশটা আবার শান্ত হয়ে গেল।
"ওটা কী ছিল?" রিয়া ইশারায় জিজ্ঞেস করল।
অরিন্দম কাঁধ ঝাঁকালেন। তার মুখ চিন্তায় ভরা। এটা কি কোনো সতর্কবার্তা ছিল? প্রাণীগুলো কি তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এখন পুরোপুরি সচেতন?
সেই দিন থেকেই তারা বুঝতে পারল, দ্বীপের প্রাণীগুলো তাদের উপর নজর রাখছে। তারা এখন আর কেবল শব্দের জন্য অপেক্ষা করছে না, তারা সক্রিয়ভাবে শিকার খুঁজছে।
হতাশা আর ভয় দলের সদস্যদের একে অপরের থেকে মানসিকভাবে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। রশিদ ভাই সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতেন। তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে তিনি হয়তো এমন কিছু বুঝতে পারছিলেন, যা বাকিরা পারছিল না। তিনি কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, যেন উদ্ধারের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন।
সোহমের অবস্থা সবচাইতে খারাপ। সে প্রায়ই একা একা বসে বিড়বিড় করত, তারপর শব্দ হচ্ছে বুঝতে পেরে নিজের মুখে নিজেই চাপা মারত। তার স্নায়ু প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থায়।
অরিন্দম বুঝতে পারছিলেন, এভাবে আর বেশিদিন চলবে না। তাদের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। হয় বিক্রমের কথামতো লড়াই করে মরতে হবে, অথবা এখান থেকে পালানোর জন্য একটা মরিয়া চেষ্টা করতে হবে। পালানোর পথ একটাই—দ্বীপের সবচাইতে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায় পৌঁছানো। সেখান থেকে হয়তো কোনো চলন্ত জাহাজ বা বিমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সেই পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটা গিয়েছে একটা সরু গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে। আর অরিন্দমের মন বলছিল, ওই গিরিখাতটাই হলো শয়তানদের মূল শিকারক্ষেত্র।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion