Episode 8535 words3 views

অধ্যায় ৮: শব্দের ফাঁদ

অরিন্দম তার পালানোর পরিকল্পনাটা দলের বাকিদের সামনে তুলে ধরলেন। তিনি একটা মানচিত্রের মতো মাটিতে এঁকে দেখালেন। তাদের শিবির থেকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা, আর মাঝখানের সেই ভয়ঙ্কর গিরিখাত। "আমাদের ওপারে যেতেই হবে," তিনি ইশারায় বোঝালেন। "কিন্তু গিরিখাতটা পার হওয়া প্রায় অসম্ভব। ওখানে ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি থাকতে পারে।" বিক্রম তার হাতে ধরা পাথরের বর্শাটা দেখাল। তার ভাবটা এমন যে, সে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু অরিন্দমের পরিকল্পনা ছিল অন্য। লড়াই নয়, কৌশল। "আমাদের ওদের মনোযোগ অন্য দিকে সরাতে হবে। একটা শব্দের টোপ তৈরি করতে হবে, যাতে ওরা গিরিখাত ছেড়ে অন্যদিকে যায়।" সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সোহমের দিকে। দলের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সে-ই। সোহম প্রথমে ভয়ে মাথা নাড়ল। তার পক্ষে আর কোনো ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রিয়া তার কাঁধে হাত রাখল। তার চোখের ভাষায় ছিল ভরসা আর অনুরোধ। সোহম আর না করতে পারল না। শুরু হলো এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। সোহমের কাছে তার ভাঙা জিনিসপত্রের মধ্যে একটা পুরনো অ্যানালগ ঘড়ি ছিল। ঘড়িটা চলছিল না, কিন্তু ভেতরের টাইমারটা কাজ করলেও করতে পারে। সে তার সমস্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ঘড়িটা খুলল। তার লক্ষ্য হলো, ঘড়ির অ্যালার্ম সিস্টেমটাকে ব্যবহার করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর আওয়াজ তৈরি করা। তারা সবাই মিলে কাজে লেগে গেল। রিয়া জঙ্গল থেকে এক ধরনের শুকনো বীজ নিয়ে এল, যেগুলো একে অপরের সাথে ধাক্কা লাগলে বেশ জোরদার র‍্যাটলিং শব্দ হয়। বিক্রম সেই বীজগুলোকে একটা বড়, শুকনো নারকেলের খোলার মধ্যে ভরল। রশিদ ভাই গাছের ছাল দিয়ে শক্ত দড়ি তৈরি করলেন। সোহম তার কাঁপা কাঁপা হাতে ঘড়ির ভেতরের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করতে লাগল। তার দরকার ছিল একটা ব্যাটারি, যা তার কাছে ছিল না। অনেক খোঁজার পর সে তার হেডফোনের ভেতর থেকে একটা ছোট বাটন সেল বের করল। ওটাই ছিল শেষ আশা। প্রায় দুই দিন ধরে চলল তাদের এই নিঃশব্দ কর্মযজ্ঞ। অবশেষে, সোহম একটা অদ্ভুত দেখতে যন্ত্র তৈরি করল। ঘড়ির টাইমারের সাথে ব্যাটারি আর একটা ছোট ধাতব পাত জুড়ে দিয়েছে সে। নির্দিষ্ট সময় পর, টাইমারের কাঁটাটা সেই ধাতব পাতকে স্পর্শ করবে, যার ফলে একটা বৈদ্যুতিক সার্কিট সম্পূর্ণ হবে। সেই সার্কিটের অন্য প্রান্তে লাগানো আছে একটা ছোট মোটর, যার সাথে নারকেলের খোলাটা বাঁধা। টাইমার চালু হলে মোটরটা ঘুরবে, আর নারকেলের খোলাটা দুলে উঠে ভেতরের বীজগুলো শব্দ করতে শুরু করবে। এটা একটা জুয়া। যদি যন্ত্রটা কাজ না করে, বা সময়ের আগে বা পরে চালু হয়, তাহলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। অরিন্দম পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দিলেন। তারা গিরিখাত থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে, উল্টো দিকে এই 'শব্দের ফাঁদ'টা লাগাবে। টাইমার সেট করা হবে এক ঘণ্টার জন্য। এই এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের গিরিখাতটা পার হতে হবে। তারপর যন্ত্রটা চালু হলে, প্রাণীগুলো সব শব্দের উৎসের দিকে ছুটে যাবে, আর তারা সেই সুযোগে পাহাড়ে ওঠার সময় পাবে। পরিকল্পনাটাฟังดู (শুনতে) ভালো হলেও, এর প্রত্যেকটা ধাপে ছিল মারাত্মক ঝুঁকি। প্রথম ঝুঁকিটা হলো, ফাঁদটা লাগাতে যাবে কে? জায়গাটা জঙ্গলের গভীরে, বিপদে ভরা। রশিদ ভাই এগিয়ে এলেন। তিনি ইশারায় বোঝালেন, এই কাজটা তিনি করবেন। জঙ্গলের পথ তার সবচাইতে ভালো চেনা। আর তার বয়স হয়েছে, যদি কিছু হয়েও যায়, দলের তরুণ সদস্যদের বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি। কেউ তার সাথে একমত হলো না। কিন্তু রশিদ ভাই তার সিদ্ধান্তে অটল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে সবাই বুঝতে পারল, তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। অগত্যা, সবাই রাজি হলো। পরের দিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে তাদের অভিযান শুরু হওয়ার কথা। সেই রাতটা ছিল তাদের জীবনের সবচাইতে দীর্ঘ রাত। প্রত্যেকেই জানত, পরের সূর্যোদয় হয়তো তাদের মধ্যে কারো কারো জন্য জীবনের শেষ সূর্যোদয় হতে চলেছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion