Episode 31073 words0 views

নিথর পদচিহ্ন : পর্ব ৩

নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints) পর্ব ৩: অন্ধকারের মুখোমুখি নার্সারির মালিকের দেওয়া ঠিকানাটি রিমার চোখের সামনে এক বিভৎস ছায়ার মতো ভাসছিল, যা তার প্রতিটি শ্বাসকে ভারী করে তুলছিল। শহর থেকে খানিকটা দূরে, এক নির্জন, প্রায় পরিত্যক্ত এলাকায়, যেখানে দিনের আলোও পৌঁছাতে দ্বিধা করে। চারপাশে আগাছার জঙ্গল, আর পুরনো, ভাঙা দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি বাড়ি, যার প্রতিটি ইঁটে যেন এক দীর্ঘশ্বাস জমা ছিল। এমন জায়গায় একজন ‘উদ্ভিদবিদ’ কেন থাকবে, তা রিমার কাছে স্পষ্ট ছিল — এই নির্জনতাই খুনীর আশ্রয়, তার অন্ধকার খেলার মঞ্চ। সে জানে, এই বাড়িটা শুধু একটা ঠিকানা নয়, এটা সেই অন্ধকার জগতের প্রবেশপথ, যেখানে খুনী তার বীভৎস খেলা খেলেছে, এবং হয়তো এখনও খেলছে। পরদিন সকালে, রিমা এবং তার টিম নার্সারির মালিকের দেওয়া ঠিকানাটির দিকে রওনা হল। সাথে পর্যাপ্ত ফোর্স এবং অভ্রজিৎ মিত্র, যদিও রিমার মন বলছিল, এই যাত্রা তাদের জন্য কোনো সাধারণ অভিযান নয়, বরং এক অজানা ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। রিমার পরিকল্পনা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তৈরি করা হয়েছিল। সে জানত, এই অভিযান সামান্যতম ভুলও মারাত্মক হতে পারে, তাদের জীবনও কেড়ে নিতে পারে। তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি, তাই তারা সিভিল পোশাকে গেল, যাতে কোনো সন্দেহ তৈরি না হয়, যেন তারা এক গোপন মিশনে নেমেছে। রিমার বুকে এক চাপা উত্তেজনা, এক ধরণের অস্থিরতা অনুভব করছিল। এই প্রথম তারা খুনীর এত কাছাকাছি। কিন্তু এই নৈকট্যই সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ শিকারী নিজেই শিকার হতে পারে, বিশেষ করে যখন শিকারী এতটাই ধূর্ত। রিমার প্রতিটি স্নায়ু যেন সতর্ক হয়ে ছিল, প্রতিটি মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত। সূর্য তখন মাথার উপর, কিন্তু তার আলো যেন এই স্থানে পৌঁছাতেই পারছিল না। নিস্তব্ধ, পুরনো বাড়িটির দিকে তারা এগোচ্ছিল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে এক অদৃশ্য প্রাচীর তাদের ঘিরে ধরছিল। চারপাশের গাছপালা এত ঘন যে দিনের আলোও যেন সেখানে পৌঁছাতে দ্বিধা করছিল, এক অন্ধকার, শীতল ছায়া পুরো এলাকাকে গ্রাস করে রেখেছিল। বাড়ির সামনে এসে তারা থমকে দাঁড়াল। গেট ভাঙা, চারপাশে ধুলো আর মাকড়সার জাল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি যেন বহুকাল ধরে একটি ভূতুড়ে বাড়ি। অভ্রজিৎ তার রিভলভার বের করে প্রস্তুত হলো, তার হাতের মুঠো শক্ত। রিমা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নিশ্চিত করল, তারা প্রস্তুত, কিন্তু তাদের চোখ মুখে এক ধরণের চাপা ভয় স্পষ্ট। তারা সাবধানে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রতিটি পদক্ষেপে মাটির শুকনো পাতার মচমচ শব্দ এক অশুভ নিস্তব্ধতাকে যেন আরও গাঢ় করে তুলছিল, যা তাদের নিজেদের হৃদস্পন্দনের শব্দকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল। রিমা অনুভব করল এক তীব্র ঠান্ডা বাতাস, যা এই গরমের দুপুরেও তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। ভেতরের বাতাস যেন কোনো এক অজানা ভয় আর পুরোনো যন্ত্রণার ভার বহন করছিল, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠছিল। প্রথম ঘরের দরজাটা ভাঙা, আর ভেতরে অদ্ভুত একটা গন্ধ— রাসায়নিক, পচা ফুলের, আর তার সাথে পচনশীল কিছুর এক অদ্ভূত, গা গুলানো মিশ্র গন্ধ। রিমা তার নাকের ওপর হাত রাখল, অভ্রজিৎও একই কাজ করল, যেন সেই দুর্গন্ধ তাদের ভেতরে প্রবেশ করে তাদের সত্তাকেও কলুষিত করে তুলছিল। এই গন্ধটা তাদের স্নায়ুতে এক ধরণের বিরক্তি আর উদ্বেগ সৃষ্টি করছিল, যেন খুনীর উপস্থিতি প্রতিটি কোণায়। ধীরে ধীরে তারা ভেতরের দিকে এগোতে লাগল। প্রতিটি কক্ষ ছিল প্রায় খালি, ভাঙা আসবাবপত্র আর ধুলোয় ঢাকা, যেন সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু একটি ঘরে ঢুকেই তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কক্ষটি অন্য সব কক্ষ থেকে আলাদা ছিল। এখানে ছিল এক অদ্ভুত ধরণের ল্যাবরেটরি। টেবিলের উপর কাঁচের শিশি, টেস্ট টিউব, আর কিছু অচেনা যন্ত্রপাতি, যা কোনো সাধারণ উদ্ভিদবিদের গবেষণাগার ছিল না। দেয়াল জুড়ে কিছু অদ্ভুত নকশা আর ছবি – বীভৎস সব ক্যাকটাসের ছবি, কিছু শুকানো ক্যাকটাসের পাতা কাঁচের ফ্রেমে আটকানো, যেন সেগুলো কোনো মূল্যবান শিল্পকর্ম। আর হ্যাঁ, তারা সেই ধূসর রঙের পাতাগুলো দেখতে পেল, যা তারা এতকাল ধরে খুঁজছিল। এইখানে সেগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে সাজিয়ে রাখা, যেন কোনো এক বিকৃত শিল্পী তার সেরা কাজগুলো প্রদর্শন করছে! রিমার চোখে এক ধরণের ভয়ংকর আবিষ্কারের ঝলক। খুনী শুধু হত্যাই করেনি, সে তার অপরাধগুলোকে এক ধরণের বিকৃত শিল্প হিসেবে দেখত, প্রতিটি ভুক্তভোগী যেন তার ক্যানভাসের অংশ ছিল, তার নিথর মডেল। টেবিলের এক কোণায় একটি খোলা ডায়েরি পড়ে আছে। রিমার হাত কাঁপছিল যখন সে ডায়েরিটা তুলল, যেন সে কোনো নিষিদ্ধ জিনিসের স্পর্শ করছে। প্রথম পাতায় লেখা: “আমার কাজ, আমার শিল্প… নিথর সৌন্দর্য।” রিমার শ্বাস আটকে এল। এটা খুনীর ডায়েরি। তার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকার চিন্তাভাবনার খণ্ডচিত্র, এক বিকৃত মনের উন্মোচন। ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতেই রিমার শরীর হিম হয়ে এল। পাতার পর পাতা ধরে খুনী তার শিকারদের বিবরণ লিখে রেখেছে। তাদের নামের পাশে বিভিন্ন বীভৎস ক্যাকটাসের নাম, যেন প্রতিটি জীবন ছিল তার সংগ্রহের এক একটি বিরল নমুনা। কিভাবে তাদের হত্যা করেছে, প্রতিটি খুঁটিনাটি – ভুক্তভোগীর শ্বাসরোধের শেষ মুহূর্ত, তাদের চেঁচামেচি, তাদের অসহায় শরীর কিভাবে নিথর হয়ে গেল, সবকিছুই সে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, প্রায় কাব্যিক ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। রিমার মনে হলো, সে যেন খুনীর বিকৃত মনের ভেতরে ঢুকে গেছে, তার অন্ধকারতম কল্পনার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছিল খুনীর এক ধরণের মানসিক বিকৃতি, যা তাকে নারীদের উপর এমন ভয়ংকর অপরাধ ঘটাতে উৎসাহিত করেছে। ভুক্তভোগীদের অসহায় আর্তনাদ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা, সবকিছুই সে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, কোনো অনুশোচনা ছাড়াই বর্ণনা করেছে। এই ডায়েরিটা শুধু খুনের বর্ণনা ছিল না, ছিল খুনীর ভেতরের অন্ধকার আর অসুস্থতার এক প্রতিচ্ছবি, এক বিকৃত মূর্তির আত্মজীবনী। অভ্রজিৎও ডায়েরিটা দেখতে শুরু করেছিল, তার মুখে সাদা, তার চোখগুলো যেন ভয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছিল। “ম্যাডাম, এ যে এক সাইকো!” সে ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট আতঙ্ক। রিমা তখনো ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাচ্ছিল, প্রতিটি নতুন পাতা যেন এক নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসছিল, প্রতিটি বাক্য যেন খুনীর আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা অশুভ সত্তার দিকে নির্দেশ করছিল। হঠাৎ রিমার চোখ পড়ল ডায়েরির শেষ পাতায়। শেষ পৃষ্ঠায় হাতে লেখা এক বার্তা, যা তাদের রক্তের গতি থামিয়ে দিল: “আপনার আগমন, আমার শিল্পকর্মের নতুন দর্শক। খেলা শুরু হলো।” রিমা আর অভ্রজিৎ একে অপরের দিকে তাকাল, তাদের মুখে স্পষ্ট ভয়। খুনী জানত তারা আসছে। এই বাড়িটা শুধু তার গবেষণার স্থান ছিল না, এটা ছিল তাদের জন্য পাতা একটি নিখুঁত ফাঁদ। তারা এতদিন ধরে যাকে খুঁজছিল, সে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছিল, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস হয়তো সে শুনতে পাচ্ছিল। খুনী তাদের উপর নজর রাখছে! একটা ঠান্ডা আতঙ্ক রিমার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। এই বাড়িতে তাদের উপস্থিতি খুনী নিশ্চিতভাবে টের পেয়েছে, এবং সে হয়তো তাদের চারপাশে অদৃশ্যভাবে লুকিয়ে আছে, প্রতিটি ছায়ার আড়ালে। কিন্তু সে কোথায়? সে কি এই বাড়ির ভেতরেই আছে, এই নিস্তব্ধতার মধ্যে, নাকি কোথাও থেকে তাদের দেখছে, তার অন্ধকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করছে? “কুইক! বাড়িটা ভালো করে সার্চ করো! খুনী আশেপাশেই আছে!” রিমা চিৎকার করে উঠল, তার কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা আর এক ধরণের অস্থিরতা। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিমার মনে হলো, এই বাড়িটা যেন এক বিশাল ফাঁদ, আর তারা সেই ফাঁদের ভেতরে আটকা পড়ে আছে, অদৃশ্য জালে জড়িয়ে গেছে। প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ যেন এক নতুন আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। খুনী তাদের সাথে খেলা শুরু করেছে, আর এই খেলাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে চলেছে, যেখানে তাদের জীবনও বাজি। এই ফাঁদ থেকে বের হওয়া সহজ হবে না, কারণ শিকারী এখন নিজেরাই। ক্রমশ……

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion