নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints)
পর্ব ৫: এক নতুন রহস্য
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর রিমার হাত থেকে রিসিভারটা আলগা হয়ে নিচে পড়ে গেল, কাঁচের ভাঙা আওয়াজের মতো, যা নিস্তব্ধতাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলল। তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, যেন হৃদপিণ্ডটা শরীরের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে, প্রতিবার ফুসফুসে বাতাস টানার সময় এক অদৃশ্য হিম তার শরীরকে গ্রাস করছিল। তার অফিস রুমের নিস্তব্ধতা যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল, প্রতিটি ছায়া যেন এক অশুভ উপস্থিতি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার শেষ শক্তিটুকুও শুষে নিতে চাইছে। অভ্রজিৎ তখন বাড়ি চলে গেছে। রিমা একা। ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে এসি থেকে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো হিমশীতল বরফখণ্ডে আটকা পড়েছে, ভেতর থেকে জমে যাচ্ছে তার সমস্ত সত্তা, প্রতিটি রক্তকণিকা শীতল হয়ে যাচ্ছে। খুনীর সেই ঠান্ডা, বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠস্বর তার কানের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল – “খেলা আমি শুরু করেছি, আমিই শেষ করব।” এই প্রথম খুনী তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করল, তার অস্তিত্বের গভীরতম কোণে আঘাত হানল, তার মানসিক দুর্গে ফাটল ধরিয়ে দিল, যা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। এটা শুধু একটা ফোন কল ছিল না, এটা ছিল এক ধরণের মানসিক আক্রমণ, যা রিমার ভেতরের সমস্ত শক্তিকে শুষে নিচ্ছিল, তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল একটু একটু করে, এক দীর্ঘ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। সে অনুভব করল তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস যেন একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে, তার দৃঢ়তা যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, আর তার মনের ভেতর এক ভয়ংকর অন্ধকার ক্রমশ বড় হচ্ছে, যা তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরছে।
পরদিন সকালে অভ্রজিৎ এবং সাইবার ক্রাইম টিম মিলে ফোনের উৎস ট্র্যাক করার চেষ্টা করল। প্রতিটি ডিজিটাল পথ তারা অনুসরণ করল, প্রতিটি সার্ভার, প্রতিটি নেটওয়ার্ক খুঁটিয়ে দেখল, কিন্তু ব্যর্থ হলো। নম্বরটা ছিল একটি ডাম্প ফোনের, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সক্রিয় ছিল এবং তারপর সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, যেন ফোনটি নিজেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে। “ম্যাডাম, কোনো ট্রেস নেই,” অভ্রজিৎ হতাশভাবে জানাল, তার কণ্ঠে স্পষ্ট পরাজয়ের সুর। “সে এতটাই সতর্ক যে কোনো ডিজিটাল পদচিহ্ন রাখছে না। যেন সে আমাদের প্রতিটি চাল আগে থেকেই জানে, ম্যাডাম, প্রতিটি পদক্ষেপ। সে এক অদৃশ্য সত্তা।” রিমার মনে হলো, খুনী যেন তাদের প্রতিটি চাল আগে থেকেই জানে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সে আগে থেকে অনুমান করতে পারে, আর তাদের ব্যর্থতা দেখে দূর থেকে হাসছে। তার এই অদৃশ্য উপস্থিতি রিমার মনকে আরও বেশি উত্তেজিত করে তুলছিল, যেন সে অদৃশ্য সুতো দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, আর তারা কেবল তার হাতের পুতুল।
খুনীর এই সরাসরি আক্রমণ রিমার মানসিক পতনকে আরও দ্রুত করে তুলল। সে তার সহকর্মী এবং এমনকি নিজের থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে, আর সেই দেয়াল তাকে এক অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি করে ফেলেছে। দিনের পর দিন সে কেবল এই কেসের ফাইলগুলো নিয়ে পড়ে থাকত, প্রতিটি সূত্র, প্রতিটি সম্ভাবনার পেছনে ছুটত, যেন এক অদৃশ্য তাড়নায় সে নিজেই এক ক্ষুধিত শিকারী, যে তার শিকারের গন্ধ পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছে। তার খাওয়া-ঘুম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চোখের নিচে কালি আরও গভীর হয়ে উঠল, তার ত্বক বিবর্ণ হয়ে গেল, যেন সে এক জীবিত মৃতদেহ, যার কেবল শ্বাসপ্রশ্বাসটুকু অবশিষ্ট আছে, আর প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসেই যন্ত্রণা। অভ্রজিৎ তাকে বিশ্রাম নিতে বলত, ভালো করে খেতে অনুরোধ করত, কিন্তু রিমার চোখে তখন এক ধরণের উন্মাদনা, এক ধরণের ভয়াবহ জেদ, যা তাকে আরও বেশি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, এক অতল গহ্বরের দিকে। সে ঘুমালে সায়নী, অনামিকা, রুমা সেনের বিকৃত মুখগুলো তাকে তাড়া করত, তাদের নিথর শরীরগুলো যেন তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলত – “কেন, রিমা? কেন তুমি আমাদের বাঁচাতে পারোনি? কেন তুমি আমাদের রক্ষা করতে পারোনি, যেমন তুমি নিজেকেও রক্ষা করতে পারোনি? তুমি কি ব্যর্থ?” তার অতীতের সেই ট্র্যাজেডি, যেখানে সে প্রিয়জনকে রক্ষা করতে পারেনি, তা এই কেসগুলোর সাথে মিলেমিশে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছিল, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল। মাঝে মাঝে তার মনে হতো, এই ছায়াগুলো কি সত্যিই আছে, নাকি তার নিজেরই মনের সৃষ্টি?
রিমার একটাই বিশ্বাস ছিল – খুনীকে ধরতে হবে। এই বিশ্বাসই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, অন্যথায় সে হয়তো নিজেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যেত, খুনীর ফাঁদে নিজেই আটকা পড়ত, আর খুনীর আরেকটি শিল্পকর্ম হয়ে যেত। সে জানত, এই কেসটা এখন তার জন্য কেবল একটা অপরাধ নয়, বরং নিজেকে প্রমাণের লড়াই। সে এই খেলায় হারতে পারে না, যদি সে হারে, তাহলে সে নিজের কাছেই হেরে যাবে, নিজের সত্ত্বাকে হারাবে, এবং সেই অন্ধকার গহ্বরে চিরতরে তলিয়ে যাবে, যেখানে কোনো মুক্তি নেই।
কয়েক দিন পর, যখন রিমার টিম মরিয়া হয়ে খুনীর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছিল, প্রতিটি শব্দে চমকে উঠছিল, প্রতিটি অচেনা মুখ তাদের সন্দেহকে জাগিয়ে তুলছিল, তখনই ঘটল আরও একটি ঘটনা। এবার শিকার একজন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, নাম ঐন্দ্রিলা রায়। কলকাতার এক অভিজাত এলাকার একটি পরিত্যক্ত থিয়েটার হল থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার হলো, যেখানে বহু বছর ধরে কোনো আলোর রেখা পড়েনি। সায়নী, অনামিকা, রুমা সেনের মতোই তার শরীরের ওপরও ছিল একই ধরণের বীভৎস চিহ্ন, হাতের কব্জিতে সেই দড়ির দাগ, এবং তার চুলের সাথেও সেই ধূসর রঙের শুকনো ক্যাকটাসের পাতা। কিন্তু এবার আরও কিছু ছিল – যা ছিল খুনীর এক নতুন, বিদ্রূপাত্মক বার্তা, এক অশুভ স্বাক্ষর।
ঐন্দ্রিলার মৃতদেহের পাশে একটি ছোট, হাতে আঁকা স্কেচ পাওয়া গেল। স্কেচটিতে একটি ক্যাকটাসের প্রতিকৃতি, তার ঠিক নিচে একটি পুরনো, জীর্ণ লাইব্রেরির অস্পষ্ট ছবি। সেই লাইব্রেরির প্রতিটি জানালা, প্রতিটি ভাঙা দেয়াল যেন কোনো এক গোপন রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এক লুকানো পথের দিশা। আর ছবির নিচে একটি অদ্ভুদ চিহ্ন, যা রিমা আগে কোথাও দেখেনি, যেন কোনো এক প্রাচীন সংকেত, যার অর্থ কেবল খুনীই জানে, আর সে তাদের সাথে এই সংকেতের খেলা খেলছে। এটা কি খুনীর নতুন ধাঁধা? সে কি তাদের একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে, নাকি সে তাদের সাথে এক ধরণের বুদ্ধির খেলা খেলছে, তাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে, এক ভয়ংকর ফাঁদে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে? রিমার মনে হলো, খুনী তার শিল্পকর্মের ধারা পরিবর্তন করেছে, সে এখন আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে, যেন সে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের বুদ্ধিমত্তাকে উপহাস করছে, তাদের অক্ষমতাকে দেখে হাসছে।
থিয়েটার হলটি ছিল বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। এর ভেতরে এক ধরণের চাপা বিষাদ আর পুরোনো স্মৃতির গন্ধ লেগেছিল, যেন মৃতদেহটি তখনও সেই গন্ধ বহন করছিল, আর প্রতিটি কোণায় তার শেষ আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। রিমার টিম প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ভাঁজ পরীক্ষা করল, কিন্তু ঐন্দ্রিলার খুনের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা কোনো নতুন সূত্র পাওয়া গেল না। খুনী যেন এই জীর্ণ হলটিকে তার অপরাধের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিল, যেখানে সে তার বীভৎস নৃত্য প্রদর্শন করেছিল, আর দর্শকদের আসনগুলো ছিল ফাঁকা, শুধু তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল, যারা এই খেলাটার পরবর্তী শিকার।
ঐন্দ্রিলার মৃতদেহের পাশে পাওয়া স্কেচটি রিমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। সে অভ্রজিৎকে নির্দেশ দিল কলকাতার সমস্ত পুরনো লাইব্রেরির তালিকা সংগ্রহ করতে, বিশেষ করে যেগুলো এই স্কেচের সাথে মিলে যায়। রিমার মনে হলো, খুনী তাদের একটি নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দিচ্ছে, একটি নতুন রহস্যের দিকে, এক এমন গোলকধাঁধায় যেখানে প্রতিটি মোড়েই বিপদ লুকিয়ে আছে, আর প্রতিটি দরজা তাদের জন্য নতুন এক আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কেন? সেই লাইব্রেরির সাথে খুনীর কী সম্পর্ক? নাকি ঐন্দ্রিলার সাথে? প্রতিটি নতুন সূত্র যেন এক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছিল, যা তাদের গভীর থেকে গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, এক এমন অন্ধকার অতলে যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে না, আর কেবল খুনীর ইচ্ছাই রাজত্ব করে।
রিমার মনে হচ্ছিল, খুনীর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন উদ্দেশ্যপূর্ণ। সে কেবল হত্যাই করছে না, সে যেন একটি বার্তা পাঠাচ্ছে, একটি গল্প বলছে, যা তারা বুঝতে পারছে না, অথচ সেই গল্প তাদের চোখের সামনেই চলছে, প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে লেখা হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা রায়, একজন নৃত্যশিল্পী। সায়নী দেব, কলেজ ছাত্রী। অনামিকা বসু, পেশাদার। রুমা সেন, স্কুল শিক্ষিকা। এই চারজনের মধ্যে কি কোনো সাধারণ যোগসূত্র আছে? তাদের পেশা, তাদের সামাজিক অবস্থান – সবই ভিন্ন। তাহলে কেন এই চারজন? রিমার মনে এক নতুন সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল, এক ঠান্ডা অনুভূতি তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল, যা তার মনকে আরও বেশি অস্থির করে তুলল। খুনীর প্রতিটি শিকারের পেছনে কি কোনো গভীর, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য আছে, যা এখনো তাদের কাছে স্পষ্ট নয়, এক এমন গোপন ইতিহাস যা তাদের কল্পনার বাইরে?
রিমা তার টেবিলের উপর চারটি ভুক্তভোগীর ছবি সাজিয়ে রাখল। চারজন নারী, চারজন ভিন্ন জীবন, কিন্তু সবারই শেষ পরিণতি একই, একই বীভৎস নিয়তি, একই শিল্পী দ্বারা সৃষ্ট। রিমার চোখে ঘুম ছিল না। সে জানত, খুনী তার প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে, তার প্রতিটি দুর্বলতা জানে, এমনকি তার প্রতিটি ভয়ও সে জানে, যা তাকে এই খেলায় আরও বেশি আনন্দ দিচ্ছে, আর তাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। এই নতুন ধাঁধা, এই লাইব্রেরির রহস্য – এই সবকিছুই ছিল খুনীর এক চাল, যা রিমার ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার চূড়ান্ত পরীক্ষা, আর সে অনুভব করছিল যে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, সে ক্রমশ তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। রিমা বুঝতে পারছিল, এই খেলা ক্রমশ আরও ব্যক্তিগত এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সে অনুভব করছিল, খুনী তাদের খুব কাছাকাছি আছে, কিন্তু তাকে ধরা যেন এক অসম্ভব কাজ, কারণ সে যেন এক অদৃশ্য ছায়া, যা তাদের নিজেদেরই মানসিক গহ্বরে প্রবেশ করতে চাইছে, তাদের নিজেদেরই ভেতর থেকে গ্রাস করতে চাইছে, তাদের আত্মা চুরি করতে চাইছে।
ক্রমশ….
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion