Episode 61452 words0 views

নিথর পদচিহ্ন : পর্ব ৬

নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints) পর্ব ৬: গোপন পাঠাগার ঐন্দ্রিলার মৃতদেহের পাশে পাওয়া সেই জীর্ণ লাইব্রেরির স্কেচটা রিমার টেবিলে পড়ে ছিল, যেন এক নীরব চ্যালেঞ্জ, যার প্রতিটি রেখা এক অশুভ বার্তা বহন করছিল, প্রতিটি বক্ররেখা যেন খুনীর বিকৃত মনের প্রতিচ্ছবি। অভ্রজিৎকে নির্দেশ দেওয়ার পর, সে নিজেই কলকাতার প্রাচীন ও পরিত্যক্ত লাইব্রেরিগুলোর তালিকা ঘাঁটা শুরু করল, তার চোখে এক ধরণের তীব্র অনুসন্ধিৎসা, যা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না, যেন সে এক অদৃশ্য জালে জড়িয়ে পড়ছে, যার প্রতিটি সুতো তাকে খুনীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি লাইব্রেরির ইতিহাস, তার গঠনশৈলী, এমনকি সেখানকার পুরোনো চিত্রও সে খুঁটিয়ে দেখল, যেন সে এক অদৃশ্য ধাঁধার সমাধান করতে চাইছে, যার ভুল উত্তর তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। রিমার মনে হচ্ছিল, খুনী তাকে একটা পথ দেখাচ্ছে, কিন্তু সেই পথটা কতোটা নিরাপদ, তা সে জানে না। হয়তো সে তাদের জন্য নতুন কোনো ফাঁদ পেতে রেখেছে, এক এমন ফাঁদ যা তাদের অস্তিত্বকেই গ্রাস করবে, এক এমন অতল গহ্বর যেখানে কেবল অন্ধকারই রাজত্ব করে। সাতটা পুরোনো লাইব্রেরির তালিকা তৈরি হলো। পরের দিন সকাল থেকে রিমা আর অভ্রজিৎ সেই লাইব্রেরিগুলো একে একে পরিদর্শন করতে বের হলো, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক অদেখা বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন তারা মৃত্যুর শীতলতা অনুভব করছিল। প্রতিটি লাইব্রেরির ভেতর এক ধরণের চাপা ধুলো আর পুরোনো কাগজের গন্ধ লেগেছিল, যা রিমার মনে এক অদ্ভুত বিষাদ জাগিয়ে তুলছিল, যেন এই স্থানগুলো তাদের নিজেদেরই পুরোনো, চাপা পড়া স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলছিল, এক অদেখা অতীত তাদের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। তারা প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি স্তম্ভ পরীক্ষা করছিল, স্কেচের সাথে মিলিয়ে দেখছিল, যেন প্রতিটি ভাঙা দেয়াল তাদের দিকে তাকিয়ে রহস্য করছিল, প্রতিটি ফাটল যেন খুনীর বিদ্রূপাত্মক হাসি শোনাচ্ছিল। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছিল, রিমার অস্থিরতা তত বাড়ছিল। প্রতিটি ব্যর্থ অনুসন্ধান যেন তাকে আরও হতাশ করে তুলছিল, খুনী আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল, আর এই দূরত্বের খেলা রিমার স্নায়ুতে আঘাত হানছিল, তাকে ক্রমশ উন্মাদ করে তুলছিল। ষষ্ঠ লাইব্রেরিটিতে ঢুকেই রিমা থমকে দাঁড়াল। কলকাতার এক কোণে, পুরোনো, প্রায় ভেঙে পড়া একটি স্থাপত্য, যার প্রতিটি কোণায় যেন দীর্ঘশ্বাস জমাট বেঁধে ছিল, প্রতিটি ফাটল যেন অতীতের কোনো বীভৎস ঘটনার নীরব সাক্ষী। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এটি যেন বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত, মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ, যেখানে শুধু অশুভ আত্মারা বিচরণ করে। কিন্তু ভেতরের অংশে ঢুকতেই রিমার বুকটা কেঁপে উঠল। সেই স্কেচের প্রতিটি খুঁটিনাটি মিলে যাচ্ছে – ভাঙা কাঁচের জানালা, যা থেকে দিনের আলোও যেন ভীত হয়ে প্রবেশ করছিল, পুরনো কাঠের সিঁড়ি, যা প্রতিটি পদক্ষেপে মর্মর করে উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য পদধ্বনি অনুসরণ করছিল, আর একটি বিশেষ খিলান যা স্কেচে স্পষ্ট ছিল, যেন এটিই ছিল খুনীর নিজস্ব নকশা করা এক অন্ধকার প্রবেশপথ, এক ভয়ংকর খেলার মঞ্চ। এটিই সেই লাইব্রেরি। তারা যখন লাইব্রেরির ভেতরে প্রবেশ করল, এক ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে বাতাস তাদের শরীর ছুঁয়ে গেল, যা যেন মৃতদেহের শীতলতা বহন করছিল, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠছিল। ভেতরে বইগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, ধুলোর আস্তরণে ঢাকা, যেন বহু বছর ধরে কেউ এখানে হাত দেয়নি, অথচ এক ধরণের নতুন, অস্বস্তিকর গন্ধ সেখানে মিশে ছিল – পচা মাংস আর রাসায়নিকের এক বীভৎস মিশ্রণ। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট তাকের কাছে গিয়ে রিমা লক্ষ্য করল, কিছু বই খুব যত্ন করে সাজানো, যেন কেউ নিয়মিত এখানে এসে এই বইগুলো স্পর্শ করে যেত, এক অদৃশ্য হাত যেন তখনও তাদের স্পর্শ করছিল। সে হাত বাড়িয়ে একটি বই নামাল, তার আঙ্গুলগুলো কাঁপছিল। বইটির নাম – “দ্য সাইকোলজি অফ অ্যাবস্ট্রাকশন”। এর ভেতরের পাতায় একটি নাম লেখা: “ডাঃ অনিকেত রায়”। রিমার মনে হলো, সে যেন এক অদৃশ্য সুতো খুঁজে পেয়েছে, যা তাকে এক ভয়ংকর সত্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, এক এমন অতল গহ্বরে যেখানে কোনো মুক্তি নেই। “অভ্রজিৎ, ঐন্দ্রিলার ফাইলটা দেখ। তার কোনো আত্মীয়ের নাম অনিকেত আছে কিনা?” রিমার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, এক ধরণের উত্তেজনায়, যেটা ভয়ের কাছাকাছি ছিল, প্রায় এক উন্মাদনার মতো। অভ্রজিৎ দ্রুত ফোন করে খোঁজ নিতে শুরু করল, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, তার চোখ যেন ভয় আর আতঙ্কে বিস্ফারিত। কিছুক্ষণ পর অভ্রজিৎ ফোন রেখে বলল, “ম্যাডাম, ঐন্দ্রিলা রায়ের মামার নাম অনিকেত রায়। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তার সাথে ঐন্দ্রিলার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। কিন্তু তিনি কয়েক বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গেছেন, কোনো চিহ্ন না রেখেই, যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন রাতের আঁধারে।” রিমার চোখে এক নতুন ঝলক। “মনোরোগ বিশেষজ্ঞ? তাহলে এই লাইব্রেরি আর এই বইগুলো তার ছিল।” রিমার মনে হলো, খুনী ঐন্দ্রিলার জীবনের সাথে এই লাইব্রেরির একটি অশুভ সংযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু কেন? ঐন্দ্রিলার মামা নিখোঁজ হওয়ার সাথে কি এর কোনো সম্পর্ক আছে? খুনী কি তার পরিচিত কাউকে টার্গেট করছে? নাকি ঐন্দ্রিলার মাধ্যমে সে অন্য কোনো বার্তা দিতে চাইছে, এক এমন বার্তা যা তাদের রক্ত হিম করে দেবে? তারা দ্রুত লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করল, প্রতিটি অন্ধকার গলি, প্রতিটি তাক। লাইব্রেরির একদম পেছনের একটি গোপন চেম্বার আবিষ্কার হলো। সেটি ছিল একটি ছোট, অন্ধকার কক্ষ, যা দিনের বেলাতেও যেন সূর্যের আলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিল, এক চিরস্থায়ী অন্ধকারে ঢাকা ছিল। ভেতরে একটি টেবিল, তাতে কয়েকটি ভাঙা কাঁচের শিশি আর শুকনো ক্যাকটাসের পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন কোনো এক অশুভ পূজার উপকরণ, এক বীভৎস বলিদান এখানে সম্পন্ন হয়েছে। দেয়াল জুড়ে কিছু অদ্ভুত, বিকৃত স্কেচ – মানুষের মুখ, তাদের যন্ত্রণা, আর সেই ভয়ংকর ক্যাকটাস। রিমার মনে হলো, এইখানে খুনী বসে তার পরবর্তী শিকারের পরিকল্পনা করত, তার বীভৎস কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিত, এই কক্ষটি ছিল তার অন্ধকারতম মনের প্রতিচ্ছবি, এক নরকের প্রবেশদ্বার। কিন্তু খুনী আবারও নেই। সে তাদের আসার আগেই পালিয়ে গেছে, যেন সে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আগে থেকেই জানত, তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও যেন তার কানে পৌঁছে যেত, এবং সে তাদের প্রতিটি ত্রুটি খুঁজে বের করছিল। টেবিলের উপর একটি নতুন ধাতব কাঁটা পড়ে আছে, যা রিমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছে, যেন সেটি খুনীর চোখ, যা রিমার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে, তার প্রতিটি দুর্বলতা সে জানে। খুনীর প্রতিটি চাল, তার অদৃশ্য উপস্থিতি, এবং এই নিরন্তর মানসিক খেলা রিমার শেষ ধৈর্যটুকুও কেড়ে নিচ্ছিল। সে দিন দিন আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল, তার শরীর আর মন যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, যা তাকে ধীরে ধীরে গলা টিপে মারছিল। চোখের নিচে কালো গর্ত, তার শরীর যেন আরও শীর্ণ হয়ে গেছে, এক জীবন্ত ছায়ায় পরিণত হয়েছে, যা কেবল কষ্ট আর যন্ত্রনার ভার বইছিল। রাতে তার ঘুম আসত না, আর দিনের বেলায় সে প্রতিটি ছায়ায়, প্রতিটি শব্দে চমকে উঠত, তার নিজেরই পদক্ষেপের শব্দ তাকে ভীত করে তুলত, যেন খুনীর পায়ের শব্দ তার পিছু ছাড়ছে না। তার সহকর্মীরা তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাত, তাদের ফিসফিসানি রিমার কানে আসত। “ম্যাডাম কি ঠিক আছেন?” “উনি বোধহয় ব্রেকডাউনের কাছাকাছি।” রিমার মনে হচ্ছিল, খুনী শুধু শিকারদের জীবনই নেয়নি, সে যেন রিমার মানসিক স্থিতিশীলতাও কেড়ে নিতে চাইছে, তাকে উন্মাদ করে দিতে চাইছে, তাকে নিজেরই এক অংশ করে তুলছে, এক মনস্তাত্ত্বিক বন্দী বানিয়ে তুলছে। সে অনুভব করছিল, সে যেন এক সূক্ষ্ম সুতোর উপর হেঁটে চলছে, যা যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে, আর সেই পতনের শব্দ কেবল খুনীই শুনতে পাবে। তার নিজেরই মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল। সে নিজেকে প্রশ্ন করত, “আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? নাকি এই খুনী আমাকে পাগল করে দিচ্ছে? নাকি সে আমাকে নিজেরই এক অংশ করে তুলছে, তার বীভৎস শিল্পের একটি অংশ?” লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ড. অনিকেত রায়ের বই এবং স্কেচগুলো ফরেনসিকে পাঠানো হলো। কয়েক ঘণ্টা পর, ডক্টর ভট্টাচার্য ফোন করলেন। রিমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো, ফোনের রিং যেন তার মস্তিষ্কের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, এক বিভীষিকাময় সুর বাজছিল। “ইন্সপেক্টর, আমরা একটি ভয়ঙ্কর, অপ্রত্যাশিত, এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয় আবিষ্কার করেছি।” “কী?” রিমার গলা থেকে শব্দ বের হতে চাইল না, যেন তার কণ্ঠস্বর তার নিজেরই ছিল না, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তার গলা টিপে ধরেছে। “ড. অনিকেত রায়ের কিছু পুরোনো রোগী ছিলেন, যাদের মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ততার লক্ষণ ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার নারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করত, এক ধরণের ভয়াবহ বিদ্বেষ, যা সাধারণ নয়, এক গভীর ক্ষত থেকে উৎসারিত। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, সেই রোগীদের তালিকায় এমন একজনের নাম আছে, যে এই চারজন ভুক্তভোগীর জীবনকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করেছিল, তাদের সাথে এক অদেখা সুতোয় বাঁধা ছিল, এক ভয়ংকর ভাগ্যচক্র তাদের সবাইকে জড়িয়ে রেখেছিল।” রিমার হৃদস্পন্দন থেমে গেল, তার চারপাশে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীর শব্দ যেন থেমে গিয়েছিল। “কার নাম?” তার কণ্ঠস্বর ছিল প্রায় ফিসফিসানির মতো, যেন কোনো মৃত মানুষের কথা বলছে। “নীল রায়। ড. অনিকেত রায়েরই এক ভাগ্নে, যিনি তার পরিচর্যার অধীনে ছিলেন। তিনি এক সময় মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন, বিশেষ করে নারীদের প্রতি তার এক ধরণের অস্বাভাবিক বিদ্বেষ ছিল। এবং তার নাম ঐন্দ্রিলার পুরোনো ফোনের কল লিস্টেও পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে অসংখ্য কল আদান-প্রদান হয়েছিল, এমনকি ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেও একটি কল ছিল, যা কোনো প্রত্যুত্তর পায়নি।” নীল রায়! রিমা অনুভব করল, এক বিশাল ঠান্ডা বাতাস তার শরীরে বয়ে গেল, যেন মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ তার আত্মাকে গ্রাস করছিল। খুনীর উদ্দেশ্য, তার ব্যক্তিগত যোগসূত্র, সবকিছু যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিন্তু এই স্পষ্টতা আরও বেশি ভয়ংকর ছিল, কারণ এটি কেবল একটি অপরাধের গল্প ছিল না, এটি ছিল এক মানসিক বিকারের গভীরতম দিক, এক বীভৎস উত্তরাধিকারের গল্প। খুনী কি ড. অনিকেত রায়েরই রোগী ছিল, নাকি তার পরিবারের কেউ? খুনী কি ড. অনিকেত রায়ের শিক্ষা ব্যবহার করছিল তার বীভৎস অপরাধের জন্য? রিমা তার চোখ বন্ধ করল, কারণ এই রহস্যের শেষ প্রান্তটি এখন আরও বেশি অন্ধকার, আরও বেশি ব্যক্তিগত মনে হচ্ছিল, এবং সে অনুভব করছিল যে এই অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার নিজেরই সত্তাকে কলুষিত করতে চাইছে, তাকে নিজেরই আয়নায় এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখতে বাধ্য করছে। ক্রমশ…..

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion