সুব্রত বুঝতে পারে, সে একটা খুব বিপজ্জনক খেলার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। রণেনবাবু হয়তো তার সন্দেহের কথা জেনে গেছেন, আর তাই তিনি তাকে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেন? যদি রণেনবাবুই খুনি হন, তাহলে তিনি কেন এত ঝুঁকি নিচ্ছেন? তার মনে হয়, রণেনবাবু যেন তার চেয়েও বেশি কিছু জানেন। তার মনে প্রশ্ন জাগে, রণেনবাবুর আসল উদ্দেশ্য কী?
সুব্রত ঠিক করে, সে এবার অন্য পথে হাঁটবে। সে মৃগেনবাবুর পরিবারের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। হয়তো তাদের কাছে কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে। তাদের দুঃখ ভরা গল্পে হয়তো লুকিয়ে আছে আসল অপরাধীর পরিচয়। সুব্রত মনে করে, মৃগেনবাবুর পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া তার কর্তব্য।
মৃগেনবাবুর বাড়ি গিয়ে সুব্রত জানতে পারে, তিনি স্ত্রী আর এক ছেলে রেখে গেছেন। স্ত্রী শোক সামলাতে পারছেন না, আর ছেলেটা এখনও বুঝতে পারছে না, কী হয়েছে। তাদের চোখের জল সুব্রতর মনে গভীর দাগ কাটে। সুব্রত তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারে, মৃগেনবাবু গত কয়েক মাস ধরে রাতে বাড়ি ফিরতেন খুব দেরিতে। তারা কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, অফিসের খুব জরুরি কাজ আছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারত, এর পেছনে অন্য কিছু আছে। মৃগেনবাবুর স্ত্রী জানান, তিনি প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্নে তিনি দেখতেন, কেউ যেন তার স্বামীকে তাড়া করছে এবং মারার চেষ্টা করছে।
সুব্রত মৃগেনবাবুর ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে। ছেলেটির নাম শুভ। সে খুব শান্ত আর বুদ্ধিমান। তার চোখে একটা গভীর বেদনা। একদিন শুভ সুব্রতকে জানায়, তার বাবা যাওয়ার আগে তাকে একটা পেনড্রাইভ দিয়েছিলেন। পেনড্রাইভটাতে কী আছে, সে জানে না। তবে তার মনে হয়, ওটাতে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে। শুভ জানায়, তার বাবা খুব সাবধানে পেনড্রাইভটা লুকিয়ে রেখেছিলেন, যেন কেউ খুঁজে না পায়। শুভ জানায়, তার বাবা তাকে বলেছিলেন, যদি তার কিছু হয়ে যায়, তবেই সে যেন এই পেনড্রাইভটা কাউকে দেয়।
সুব্রত উৎসাহিত হয়ে ওঠে। এটাই হয়তো তার হাতে শেষ সুযোগ। সে শুভকে বলে, পেনড্রাইভটা তাকে দিতে। শুভ প্রথমে রাজি না হলেও পরে সুব্রতর অনুরোধে রাজি হয়। সুব্রত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে যে কোনো মূল্যে এর শেষ দেখে ছাড়বে। সে জানে, এই পেনড্রাইভ তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পেনড্রাইভটা নিয়ে সুব্রত তার পুরোনো বাড়িতে ফিরে আসে। পুরোনো বাড়িটা এখন তার কাছে আশ্রয় নয়, বরং একটা দুর্গ। ল্যাপটপে পেনড্রাইভটা লাগিয়ে সে দেখে, ভেতরে অনেকগুলো ফাইল আর ফোল্ডার। সে এক এক করে ফাইলগুলো খুলতে শুরু করে। তার মনে উত্তেজনা আর ভয় একই সাথে কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সে একটা ভিডিও ফাইলের সন্ধান পায়। ভিডিওটা চালানোর আগে সুব্রত গভীর শ্বাস নেয়। সে জানে, তার সামনে যা আছে, তা হয়তো তার জীবন বদলে দেবে।
ভিডিওটা চালায় সুব্রত। ভিডিওতে দেখা যায়, মৃগেনবাবু আর রণেনবাবু একটা ঘরে বসে কথা বলছেন। তাদের মধ্যে খুব উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। রণেনবাবু মৃগেনবাবুর ওপর খুব রেগে আছেন। তিনি বলছেন, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, আর তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে?” রণেনবাবুর চোখ লাল হয়ে আছে, যেন তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। তার চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে, যেন তিনি কোনো রাক্ষস।
মৃগেনবাবু শান্তভাবে উত্তর দেন, “আমি কোনো ভুল করিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম কাজটা সঠিকভাবে হোক।” তার গলার স্বর দৃঢ়, কিন্তু তার চোখে ভয়। তিনি জানেন, তিনি এক শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি।
রণেনবাবু চিৎকার করে বলেন, “সঠিক? তুমি জানো না, তুমি কী করেছ! এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।” তার কথাগুলো যেন একটা অভিশাপের মতো শোনাচ্ছে। তার কথা শুনে মনে হয়, তিনি যেন অনেকদিন ধরে এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এরপর ভিডিওটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। সুব্রত বুঝতে পারে, এটাই মৃগেনবাবুর খুনের আগের মুহূর্তের ভিডিও। রণেনবাবু যে খুনি, তার আর কোনো সন্দেহ থাকে না। তার হাতে যেন একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। এই ভিডিও তার সব সন্দেহের অবসান ঘটায়।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion