দ্বিতীয় শিকার
প্রিয়াঙ্কা মুখার্জীর নিখোঁজ হওয়ার পর কেটে গেছে তিন দিন। দার্জিলিংয়ে থমথমে পরিস্থিতি। সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিদিন নতুন নতুন জল্পনা-কল্পনা নিয়ে খবর পরিবেশন করছে, যা জনমনে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তুলছে। পুলিশ দিনরাত এক করে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট সূত্র মিলছে না। প্রিয়াঙ্কার বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু কেউই তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারেনি। তাদের সবার বক্তব্য একই – প্রিয়াঙ্কা পার্টিতে স্বাভাবিক ছিল, কারো সাথে কোনো ঝামেলা হয়নি, এবং সে কখন বা কিভাবে চলে গেছে, তা কেউ খেয়াল করেনি। এমনকি প্রিয়াঙ্কার মোবাইল ফোনের কোনো হদিস মেলেনি, যা তদন্তকে আরও জটিল করে তুলছিল। ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো ধাতব কণাটির রিপোর্টও এখনও আসেনি। এই নিষ্ক্রিয়তা অরুণিমাকে আরও অস্থির করে তুলছিল। তার মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক অদৃশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করছেন, যে প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে।
অরুণিমা সেনগুপ্তের উপর চাপ বাড়ছিল। কলকাতা থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত ফোন করে কেসের অগ্রগতি জানতে চাইছিলেন। দার্জিলিং-এর পুলিশ সুপারও তার উপর দ্রুত ফলাফল আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন। স্থানীয় রাজনৈতিক চাপও বাড়ছিল, কারণ মুখার্জী পরিবার শহরের প্রভাবশালী মহলের অংশ। অরুণিমা জানতেন, এই ধরনের কেসে সময় খুবই মূল্যবান। প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট অপহৃতের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে। তার মনে হচ্ছিল, ঘড়ির কাঁটা যেন দ্রুত টিক টিক করে বাজছে, আর প্রতিটি টিক যেন প্রিয়াঙ্কার জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
চতুর্থ দিনের সকালে, যখন অরুণিমা থানায় বসে প্রiaঙ্কার কেস ফাইলটি আবারও খুঁটিয়ে দেখছিলেন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি তারিখ, প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য বিশ্লেষণ করছিলেন, তখনই একটি ফোন এলো। সুব্রত রায় ফোনটি ধরেছিলেন, তার মুখ মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার চোখে এক ধরণের ভয় এবং উদ্বেগ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
“ম্যাডাম… আরেকটা ঘটনা ঘটেছে,” সুব্রতের কণ্ঠস্বর প্রায় ফিসফিস করে উঠল, যেন সে নিজেই খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার হাত কাঁপছিল।
“শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, মি. বর্মার ছেলে, রাহুল বর্মা নিখোঁজ,” সুব্রত রায় বললেন। “গতকাল রাতে সে বাড়ি ফেরেনি। পরিবার আজ সকালে থানায় খবর দিয়েছে। ঠিক প্রিয়াঙ্কার মতোই, কোনো ফোন আসেনি, কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি।”
অরুণিমার কপালে ভাঁজ পড়ল। তার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। “রাহুল বর্মা? বয়স কত?” তিনি দ্রুত তার নোটবুক বের করে নিলেন।
“উনিশ বছর, ম্যাডাম। সে স্থানীয় কলেজে পড়ত। গতকাল রাতে তার বন্ধুদের সাথে শহরের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল। রেস্তোরাঁ থেকে ফেরার পথে সে নিখোঁজ হয়েছে,” সুব্রত রায় বিস্তারিত জানালেন। তার কণ্ঠস্বরে এক ধরণের অসহায়তা ছিল।
অরুণিমা দ্রুত তার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। “চলুন, দেরি না করে ঘটনাস্থলে যাই। প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ।”
মি. বর্মার বাড়িটা ছিল মুখার্জী বাড়ির থেকে খুব বেশি দূরে নয়, শহরের আরেক প্রান্তে, একটি ব্যস্ত রাস্তার পাশে। বাড়িটা আধুনিক হলেও, মুখার্জী বাড়ির মতো নির্জন এলাকায় ছিল না। বরং, তুলনামূলকভাবে জনবহুল এলাকায় অবস্থিত। অরুণিমা এবং সুব্রত যখন পৌঁছালেন, তখন সেখানেও একই রকম দৃশ্য। মি. এবং মিসেস বর্মা শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন। তাদের চোখে-মুখে হতাশা আর ভয় স্পষ্ট। মিসেস বর্মা অঝোরে কাঁদছিলেন, আর মি. বর্মা নির্বাক হয়ে শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।
“আমার ছেলেটা কোথায় গেল, ইন্সপেক্টর?” মি. বর্মা প্রায় কেঁদে ফেললেন। তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যাচ্ছিল। “ও তো এমন ছেলে নয় যে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবে। ও তো সবসময় আমাদের কথা শুনত।”
অরুণিমা শান্তভাবে তাদের আশ্বস্ত করলেন এবং রাহুলের ঘর দেখতে চাইলেন। রাহুলের ঘরটা প্রিয়াঙ্কার ঘরের মতোই পরিপাটি ছিল। কোনো জোর করে ঢোকার চিহ্ন নেই, কোনো ধস্তাধস্তির লক্ষণ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। যেন রাহুল নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গেছে। বিছানার চাদর টানটান, বইগুলো তাকে সুন্দর করে সাজানো। দেখে মনেই হচ্ছিল না যে এখানে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে।
অরুণিমা প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। বিছানার পাশে একটি বই খোলা ছিল – একটি থ্রিলার উপন্যাস। টেবিলে ল্যাপটপ, চার্জারে লাগানো। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার মতো রাহুলের মোবাইল ফোনও গায়েব। এই বিষয়টি অরুণিমাকে আরও ভাবিয়ে তুলল। মোবাইল ফোন কেন? যদি মুক্তিপণ চাওয়া না হয়, তাহলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা? নাকি তাতে এমন কোনো তথ্য ছিল যা অপরাধী গোপন রাখতে চায়?
“রাহুলের কোনো শত্রু ছিল? বা কারো সাথে কোনো ঝামেলা?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন। তার চোখ ঘরের প্রতিটি কোণে ঘুরছিল।
মি. বর্মা মাথা নাড়লেন। “না, ম্যাডাম। রাহুল খুব শান্ত স্বভাবের ছেলে। কারো সাথে তার কোনো বিরোধ ছিল না। ও নিজের পড়াশোনা আর বন্ধুদের নিয়েই থাকত.”
“তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা বান্ধবী ছিল?” অরুণিমা প্রশ্ন করলেন।
মিসেস বর্মা চোখের জল মুছে বললেন, “ওর একজন বান্ধবী ছিল, রিনা। ওরা প্রায়ই একসাথে থাকত। রিনা খুব ভালো মেয়ে। ও তো এখন রাহুলের জন্য খুব চিন্তিত।”
“রাহুল গতকাল রাতে যখন বাড়ি থেকে বের হয়, তখন কী পরেছিল? আর তার সাথে কী কী ছিল?” অরুণিমা জানতে চাইলেন। তিনি নোটবুকে সব লিখে নিচ্ছিলেন।
মি. বর্মা বললেন, “একটা জিন্স আর গাঢ় নীল রঙের জ্যাকেট পরেছিল। আর ওর মানিব্যাগ আর কলেজের আইডি কার্ড ছিল.”
অরুণিমা ঘরের মেঝেতে চোখ বুলালেন। প্রিয়াঙ্কার ঘরে যেমন একটি ধাতব কণা পেয়েছিলেন, এখানেও কি তেমন কিছু পাওয়া যাবে? তিনি সাবধানে প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করলেন, এমনকি আসবাবপত্রের নিচেও উঁকি দিলেন। অবশেষে, একটি ছোট কার্পেটের কোণে, তিনি একটি ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য কালো কণা দেখতে পেলেন। এটি প্রিয়াঙ্কার ঘরে পাওয়া কণাটির মতোই দেখতে। চকচকে, কিন্তু খুব ছোট। অরুণিমা সাবধানে কণাটি তুলে একটি ছোট জিপলক ব্যাগে রাখলেন।
“ইন্সপেক্টর, এই কণাটাও ফরেনসিক ল্যাবে পাঠান। আর রাহুলের বান্ধবী রিনা এবং তার বন্ধুদের সাথে দ্রুত কথা বলুন,” অরুণিমা বললেন। তার কণ্ঠস্বরে এক ধরণের দৃঢ়তা ফিরে এসেছে। “তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, রাহুল কখন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েছিল, কার সাথে বেরিয়েছিল, এবং তার শেষ দেখা কখন হয়েছিল।”
সুব্রত রায় মাথা নাড়লেন। “বুঝতে পেরেছি, ম্যাডাম। আমি এখনই টিমকে পাঠাচ্ছি.”
অরুণিমা জানতেন, এই দুটি অপহরণের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন রয়েছে। কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি। কোনো জোর করে ঢোকার চিহ্ন নেই। অপহৃতরা প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাদের বয়স কাছাকাছি। আর উভয় ক্ষেত্রেই মোবাইল ফোন গায়েব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, উভয় স্থানেই একই ধরনের ক্ষুদ্র ধাতব কণা পাওয়া গেছে। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না।
অরুণিমা বুঝতে পারছিলেন, এটি কোনো সাধারণ অপহরণ নয়। এর পেছনে একজন ঠান্ডা মাথার অপরাধী রয়েছে, যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তার শিকার নির্বাচন করছে। তার উদ্দেশ্য কী? প্রতিশোধ? নাকি আরও গভীর কোনো ষড়যন্ত্র? এই প্রশ্নগুলো তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। দার্জিলিংয়ের মৌন উপত্যকা যেন এক ভয়ংকর রহস্যের জাল বুনছিল, যার দ্বিতীয় শিকার ইতিমধ্যেই তার ফাঁদে পড়েছে। অরুণিমার উপর চাপ বাড়ছিল, কিন্তু তার সংকল্প আরও দৃঢ় হচ্ছিল। এই রহস্যের জট তাকে খুলতেই হবে, যত কঠিনই হোক না কেন। তিনি অনুভব করলেন, এই কেসটি তার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। দার্জিলিংয়ের এই শান্ত পাহাড়ের নিচে যে অন্ধকার লুকিয়ে আছে, তা উন্মোচন করার জন্য তাকে তার সমস্ত বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে হবে। মৌন উপত্যকা আর নীরব থাকবে না, অরুণিমা তার নীরবতা ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion