পুরনো ক্ষত
পরের দিন সকালে অরুণিমা আবার ড. প্রবীর মিত্রের বাড়িতে গেলেন। তার মনে এক নতুন উদ্দীপনা। ড. মিত্রের বিশ্লেষণ তাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। থানায় ফিরে তিনি ইন্সপেক্টর সুব্রত রায়কে ড. মিত্রের সাথে তার সাক্ষাতের কথা জানালেন এবং তার শর্তগুলোও বুঝিয়ে বললেন। সুব্রত রায় প্রথমে কিছুটা দ্বিধা করলেও, অরুণিমার দৃঢ়তা দেখে রাজি হলেন। এই মুহূর্তে তাদের যেকোনো সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। দার্জিলিংয়ের পুলিশ সুপারও ড. মিত্রের খ্যাতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাই তিনি এই অস্বাভাবিক সহযোগিতায় আপত্তি করলেন না।
ড. মিত্রের বাড়িতে পৌঁছে অরুণিমা দেখলেন, তিনি তার লাইব্রেরিতেই বসে আছেন, একটি পুরনো বই পড়ছেন। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, তার মৃদু তাপ এবং বইয়ের পুরনো গন্ধ ঘরের উষ্ণতা ও শান্ত পরিবেশ তৈরি করছিল। ড. মিত্রের চারপাশে বইয়ের স্তূপ, যেন তিনি জ্ঞানের এক সমুদ্রে ডুবে আছেন।
“আসুন, ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত,” ড. মিত্র মৃদু হাসলেন, তার চশমার উপর দিয়ে অরুণিমাকে দেখে। “আমি আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। কাল রাতে আপনার দেওয়া তথ্যগুলো আমার মনকে বেশ নাড়া দিয়েছে।”
অরুণিমা বসতেই ড. মিত্র বললেন, “আমি গত রাতে আপনার দেওয়া তথ্যগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি। দুটি পরিবারের মধ্যে সরাসরি কোনো সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও, একই ধরনের অপহরণের ঘটনা, মুক্তিপণ না চাওয়া, এবং সেই ধাতব কণার উপস্থিতি – এগুলো কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এর পেছনে একটি গভীর উদ্দেশ্য রয়েছে, যা ব্যক্তিগত প্রতিশোধের চেয়েও বড় কিছু হতে পারে। এটি হয়তো কোনো প্রতীকী প্রতিশোধ, যা সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের প্রতি ঘৃণা থেকে জন্ম নিয়েছে।”
ঠিক তখনই অরুণিমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সুব্রত রায় ফোন করেছেন। অরুণিমা দ্রুত ফোন ধরলেন।
“ম্যাডাম, ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে!” সুব্রতের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। “ধাতব কণাটি একটি বিরল সংকর ধাতু, যা সাধারণত উচ্চমানের ঘড়ি বা সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ল্যাব থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে এটি টাইটানিয়াম এবং নিকেলের একটি বিশেষ মিশ্রণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এই কণাটিতে একটি মাইক্রোস্কোপিক খোদাই করা চিহ্ন পাওয়া গেছে। একটি ছোট, সূক্ষ্ম ‘S’ অক্ষর। এটি এতটাই ছোট যে খালি চোখে দেখা অসম্ভব।”
অরুণিমা ড. মিত্রের দিকে তাকালেন। “ডাক্তার সাহেব, ধাতব কণাটিতে একটি ‘S’ অক্ষর খোদাই করা আছে। এটি টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু।”
ড. মিত্রের চোখে এক ঝলক কৌতূহল দেখা গেল, তার শান্ত মুখেও এক ধরণের উত্তেজনা। “S? ইন্টারেস্টিং। টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু? এটি খুব শক্তিশালী এবং ক্ষয়রোধী একটি ধাতু। এটি সাধারণত বিশেষায়িত শিল্পে ব্যবহৃত হয়, যেমন উচ্চ-নির্ভুল যন্ত্রাংশ বা এমনকি কিছু সামরিক সরঞ্জাম। এটি সাধারণ কোনো জিনিস নয়।” তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। “এটি অপরাধীর ‘স্বাক্ষর’ হতে পারে, অথবা কোনো নির্দিষ্ট সংস্থার প্রতীক। কিন্তু কেন ‘S’? কোনো নাম, কোনো স্থান, নাকি কোনো বিশেষ ঘটনার প্রতীক?”
অরুণিমা সুব্রতকে নির্দেশ দিলেন, “ইন্সপেক্টর, দার্জিলিং এবং আশেপাশের অঞ্চলে এমন কোনো ঘড়ি প্রস্তুতকারক, সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক, বা এমনকি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে কিনা, যারা এই ধরনের সংকর ধাতু ব্যবহার করে, তা খুঁজে বের করুন। প্রতিটি ছোট ওয়ার্কশপ, পুরনো কারখানা – সব খতিয়ে দেখুন। আর ‘S’ অক্ষর দিয়ে শুরু হয় এমন কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির নামও খতিয়ে দেখুন, বিশেষ করে যারা মুখার্জী বা বর্মা পরিবারের সাথে কোনোভাবে যুক্ত ছিল।”
ফোন রেখে অরুণিমা ড. মিত্রের দিকে ফিরলেন। “আপনার কী মনে হয়, ডাক্তার সাহেব? এই ‘S’ অক্ষর কীসের ইঙ্গিত? আর এই ধরনের বিরল ধাতু ব্যবহার করার উদ্দেশ্য কী?”
ড. মিত্র কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তার আঙ্গুলগুলো তার দাড়িতে আলতোভাবে বুলিয়ে নিলেন। “এটি অনেক কিছুর ইঙ্গিত হতে পারে। হয়তো অপরাধীর নামের প্রথম অক্ষর, বা তার ছদ্মনাম, যা সে তার প্রতিশোধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। আবার এটি কোনো পুরনো ঘটনার সাথে জড়িত কোনো প্রতীকও হতে পারে। এই বিরল ধাতু ব্যবহার করা ইঙ্গিত দেয় যে অপরাধী হয়তো প্রযুক্তিগতভাবে বেশ দক্ষ, অথবা তার কাছে এমন কোনো উৎসের অ্যাক্সেস আছে যা সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এটি তার বুদ্ধিমত্তা এবং পরিকল্পনার গভীরতা প্রমাণ করে।”
তিনি তার টেবিলের উপর থেকে একটি পুরনো খবরের কাগজের কাটিং বের করলেন। কাগজটি হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু লেখাগুলো এখনও স্পষ্ট। “আমার সংগ্রহে কিছু পুরনো নথি আছে। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে, ১৯৭৯ সালে, দার্জিলিংয়ে একটি চা বাগানের শ্রমিকদের ধর্মঘট হয়েছিল। এটি ছিল দার্জিলিংয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় এবং সহিংস ধর্মঘট। সেই সময় বেশ কিছু সহিংস ঘটনাও ঘটেছিল, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, এমনকি কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল। মুখার্জী পরিবার সেই চা বাগানের মালিক ছিল – ‘শান্তি কুঞ্জ’ চা বাগান। তারা শ্রমিকদের দাবি মানতে রাজি ছিল না, এবং ধর্মঘট দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। আর মি. বর্মার বাবা, মি. সুরেশ বর্মা, তিনি তখন একজন ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু শ্রমিকদের পক্ষে কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিলেন বলে শোনা যায়। তবে সেই সাহায্য শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের খুব একটা কাজে আসেনি, বরং অনেকেই মনে করেছিল যে তার সাহায্য ছিল লোক দেখানো।”
অরুণিমা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তার মনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। “আপনি কি মনে করেন, এর সাথে বর্তমান অপহরণের কোনো সংযোগ থাকতে পারে?”
“সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না,” ড. মিত্র বললেন। “সেই ধর্মঘটে অনেক শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছিল, অনেকে পরিবার নিয়ে পথে বসেছিল, অনেকে তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো এই ঘটনার জন্য মুখার্জী পরিবারকে দায়ী করেছিল। তাদের মনে গভীর ক্ষোভ জমেছিল। আর বর্মা পরিবার, যারা শ্রমিকদের সাহায্য করেছিল বলে দাবি করেছিল, তাদের প্রতিও হয়তো কারো ক্ষোভ থাকতে পারে, যদি তারা সেই সাহায্য সম্পূর্ণ না করে থাকে অথবা কোনোভাবে শ্রমিকদের প্রতারিত করে থাকে। অনেক সময়, এই ধরনের সামাজিক অন্যায়ের প্রতিশোধ অনেক প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।”
অরুণিমা তার নোটবুকে লিখে নিলেন: ‘১৯৭৯ সালের চা বাগানের ধর্মঘট, শান্তি কুঞ্জ চা বাগান, মুখার্জী ও বর্মা পরিবারের ভূমিকা, শ্রমিক নেতা ও জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা’। তিনি অনুভব করলেন, এই তথ্যগুলোই হয়তো সেই অদৃশ্য সুতো, যা দুটি অপহরণকে এক করছে।
“আমাদের সেই সময়ের শ্রমিক নেতা বা যারা সেই ঘটনায় জড়িত ছিল, তাদের খোঁজ নিতে হবে,” অরুণিমা বললেন। “হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এখনও বেঁচে আছে, যারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। বিশেষ করে, যারা সেই সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের উপর নজর রাখতে হবে।”
“ঠিক তাই,” ড. মিত্র বললেন। “অনেক সময় অপরাধীরা তাদের প্রতিশোধের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, এবং যখন সুযোগ আসে, তখন তারা তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করে। এই ধরনের অপরাধীরা সাধারণত খুব ধৈর্যশীল হয়, এবং তাদের প্রতিশোধের পরিকল্পনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল হয়। তারা চায় তাদের শিকার যেন তাদের অপরাধের কারণ বুঝতে পারে, যেন তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে।”
অরুণিমা থানায় ফিরে সুব্রত রায়কে ড. মিত্রের দেওয়া নতুন তথ্যের কথা জানালেন। সুব্রত রায় প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও, অরুণিমার যুক্তিতে তিনি রাজি হলেন। এই নতুন দিকনির্দেশনা তাদের তদন্তে এক নতুন গতি আনল।
“ইন্সপেক্টর, ১৯৭৯ সালের চা বাগানের ধর্মঘট সম্পর্কে যত তথ্য পান, সংগ্রহ করুন,” অরুণিমা নির্দেশ দিলেন। “সেই সময়ের সংবাদপত্রের ফাইল, পুলিশের রেকর্ড, শ্রমিক সংগঠনের তালিকা – সবকিছু। বিশেষ করে, সেই সময় মুখার্জী এবং বর্মা পরিবারের ভূমিকা কী ছিল, তা বিশদভাবে খুঁজে বের করুন। প্রয়োজনে পুরনো শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিন, যারা এখনও জীবিত আছেন। তাদের স্মৃতি থেকে হয়তো এমন কিছু বেরিয়ে আসবে যা আমাদের এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে।”
সুব্রত রায় তার টিমকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লেন। পুরনো ফাইলপত্র ঘাঁটা, বয়স্ক শ্রমিকদের সাথে কথা বলা, এবং স্থানীয় লাইব্রেরিতে পুরনো খবরের কাগজের কাটিং খোঁজা – সব শুরু হলো। দার্জিলিংয়ের পুরনো ইতিহাসে ডুব দিতে গিয়ে তারা এমন কিছু তথ্য খুঁজে পেলেন, যা এই দুটি অপহরণের রহস্যের সাথে এক নতুন সংযোগ স্থাপন করতে শুরু করেছিল। মৌন উপত্যকার গভীরে লুকিয়ে থাকা পুরনো ক্ষতগুলো যেন ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করছিল, যা এই শান্ত পাহাড়ের বুকে এক নতুন ঝড় তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion