Episode 61350 words0 views

মৌন উপত্যকা : ষষ্ঠ অধ্যায়

গোপন সূত্র ড. প্রবীর মিত্রের নির্দেশনায় তদন্তের মোড় ঘুরে গেল। ইন্সপেক্টর সুব্রত রায় তার টিমকে নিয়ে ১৯৭৯ সালের চা বাগানের ধর্মঘট নিয়ে বিশদ অনুসন্ধান শুরু করলেন। পুরনো খবরের কাগজের ফাইলগুলো ঘাঁটা, পুলিশের সংরক্ষণাগার থেকে সেই সময়ের রেকর্ডপত্র বের করা, এবং সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল – সেই সময়ের জীবিত শ্রমিকদের খুঁজে বের করে তাদের সাথে কথা বলা। দার্জিলিংয়ের বিস্তীর্ণ চা বাগান এবং পাহাড়ের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সময়ের মানুষগুলোকে খুঁজে বের করা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমসাধ্য কাজ। কয়েকদিন ধরে সুব্রত রায় এবং তার টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন। তারা স্থানীয় লাইব্রেরির পুরনো সংবাদপত্রের সংগ্রহ থেকে ১৯৭৯ সালের ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে বের করলেন। ‘শান্তি কুঞ্জ’ চা বাগানে সেই সময় কী ঘটেছিল, শ্রমিকদের দাবি কী ছিল, মালিকপক্ষ অর্থাৎ মুখার্জী পরিবারের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, এবং ধর্মঘট দমনে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল – সব তথ্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধর্মঘটটি অত্যন্ত সহিংস রূপ নিয়েছিল। শ্রমিকদের উপর লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, এমনকি গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছিল। বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত এবং আহত হয়েছিল, এবং অসংখ্য শ্রমিককে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। মুখার্জী পরিবার তখন তাদের চা বাগানের উৎপাদন সচল রাখতে স্থানীয় গুন্ডাদেরও ব্যবহার করেছিল বলে গুজব ছিল, যদিও এর কোনো লিখিত প্রমাণ ছিল না। এই তথ্যগুলো অরুণিমার মনে এক গভীর প্রশ্ন তৈরি করল – এই গুন্ডাদের কি এখনও মুখার্জী পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে? মি. সুরেশ বর্মার ভূমিকা সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া গেল। তিনি তখন শহরের একজন উদীয়মান ব্যবসায়ী ছিলেন। সংবাদপত্রে তার কিছু ছবি ছাপা হয়েছিল যেখানে তাকে শ্রমিকদের ত্রাণ বিতরণে দেখা যাচ্ছে। কিছু প্রতিবেদনে তাকে ‘শ্রমিক দরদী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, আবার কিছু প্রতিবেদনে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে তিনি এই পরিস্থিতিকে নিজের ব্যবসায়িক লাভের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সুব্রত রায় একটি পুরনো ছবি খুঁজে পেলেন যেখানে সুরেশ বর্মাকে মুখার্জী সাহেবের সাথে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটা শম্ভু মাঝির বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। সুব্রত রায় অরুণিমাকে এই সব তথ্য জানালেন। অরুণিমা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার নোটবুকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো টুকে নিলেন। “ম্যাডাম, আমরা কয়েকজন পুরনো শ্রমিককে খুঁজে পেয়েছি, যারা এখনও জীবিত আছেন,” সুব্রত রায় বললেন। “তাদের মধ্যে একজন আছেন, নাম শম্ভু মাঝি। তার বয়স প্রায় সত্তর। তিনি তখন শান্তি কুঞ্জ চা বাগানের একজন সক্রিয় শ্রমিক নেতা ছিলেন। ধর্মঘটে তার পরিবারের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার ভাই, বোন, এমনকি তার নিজের এক সন্তানও সেই সময় মারা গিয়েছিল।” সুব্রতের কণ্ঠে এক ধরণের সহানুভূতি ফুটে উঠল। “শম্ভু মাঝি? তার সাথে কথা বলা খুব জরুরি, ইন্সপেক্টর,” অরুণিমা বললেন। তার চোখে এক ধরণের দৃঢ়তা। “তিনিই হয়তো আমাদের সেই গোপন সূত্র দিতে পারবেন, যা আমরা খুঁজছি। তার ব্যক্তিগত ক্ষতি তাকে আরও বেশি তথ্য দিতে উৎসাহিত করতে পারে।” পরের দিন সকালে অরুণিমা এবং সুব্রত রায় শম্ভু মাঝির বাড়িতে গেলেন। বাড়িটা ছিল দার্জিলিংয়ের উপকণ্ঠে একটি ছোট গ্রামে, চা বাগানের পাশেই। পুরনো, জীর্ণ একটি মাটির বাড়ি, যা সময়ের সাথে সাথে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু তার চারপাশে একটি ছোট সবজির বাগান ছিল, যা শম্ভু মাঝি নিজেই যত্ন করতেন। শম্ভু মাঝি একা থাকতেন, তার স্ত্রী বহু বছর আগে মারা গেছেন, আর ছেলেমেয়েরা কাজের সন্ধানে শহর ছেড়ে চলে গেছে। তার চোখেমুখে এক ধরণের ক্লান্তি এবং বিষণ্ণতা ছিল, যেন জীবনের সমস্ত দুঃখ তার উপর ভর করেছে। শম্ভু মাঝি তাদের দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। তার চোখে ছিল এক ধরণের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস। তিনি পুলিশকে বিশ্বাস করতেন না, কারণ তার জীবনে পুলিশ মানেই ছিল অত্যাচার আর অবিচার। তিনি তাদের বসতে বললেন, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কোনো উষ্ণতা ছিল না। “আমরা আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি, শম্ভু বাবু,” অরুণিমা শান্ত গলায় বললেন, তার কণ্ঠে সহানুভূতি মিশিয়ে। “আমরা ১৯৭৯ সালের চা বাগানের ধর্মঘট সম্পর্কে জানতে চাই। আপনি সেই সময় শান্তি কুঞ্জ চা বাগানে কাজ করতেন, তাই না? আমরা জানি, সেই ঘটনায় আপনার পরিবার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।” শম্ভু মাঝির মুখে এক ধরণের বিষণ্ণতা নেমে এলো। তার চোখে পুরনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠল, যা তাকে স্পষ্টতই কষ্ট দিচ্ছিল। “সেই কালো দিনগুলোর কথা আর কেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ম্যাডাম? সে এক বিভীষিকাময় সময় ছিল। আমাদের জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছিল।” তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। অরুণিমা তাকে আশ্বস্ত করলেন। “আমরা জানি, সেই সময়টা আপনার জন্য খুব কঠিন ছিল। কিন্তু আপনার তথ্য আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুটি তরুণ-তরুণী নিখোঁজ হয়েছে, এবং আমরা মনে করছি এর সাথে সেই পুরনো ঘটনার কোনো সংযোগ থাকতে পারে। আমরা অপরাধীদের ধরতে চাই, যারা এই নিরীহ ছেলেমেয়েদের অপহরণ করেছে।” শম্ভু মাঝি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তার চোখ শূন্যে স্থির। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন। তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক ধরণের চাপা ক্ষোভ এবং হতাশা, যা এত বছর ধরে তার ভেতরে জমে ছিল। “শান্তি কুঞ্জ চা বাগানের মালিক মুখার্জী সাহেব ছিল একজন রক্তচোষা মানুষ। সে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিত না, আমাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। যখন আমরা ধর্মঘট করলাম, তখন সে আমাদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দিল। পুলিশ আমাদের উপর লাঠিচার্জ করল, টিয়ার গ্যাস ছুড়ল। আমার ভাই, আমার বোন – অনেকেই সেই ধর্মঘটে প্রাণ হারিয়েছিল। আমার ছোট মেয়েটা, যার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর, সেও অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিল, কারণ আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবকিছু হারিয়েছিলাম।” শম্ভু মাঝির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। অরুণিমা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এই ধরনের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি একজন মানুষের মনে কতটা গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন। “আর মি. সুরেশ বর্মা? তিনি কি শ্রমিকদের সাহায্য করেছিলেন?” শম্ভু মাঝি বিদ্রূপের হাসি হাসলেন, তার চোখে এক ধরণের তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠল। “সুরেশ বর্মা? সে ছিল একজন ভণ্ড। সে লোক দেখানোর জন্য কিছু সাহায্য করেছিল, কিন্তু আসলে সে মুখার্জী সাহেবের সাথে হাত মিলিয়েছিল। সে আমাদের বিশ্বাস অর্জন করে আমাদের দুর্বলতাগুলো মুখার্জী সাহেবকে জানিয়েছিল। তার কারণেই আমাদের ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছিল। সে চেয়েছিল মুখার্জী সাহেবের চা বাগান দখল করতে, কিন্তু পারেনি। তাই সে আমাদের ব্যবহার করেছিল, আমাদের পিঠে ছুরি মেরেছিল।” তার কণ্ঠস্বর তিক্ত হয়ে উঠল। “সে আমাদের কাছে ‘শ্রমিক দরদী’ সেজে এসেছিল, কিন্তু আসলে সে ছিল একজন শয়তান।” অরুণিমা এবং সুব্রত রায় একে অপরের দিকে তাকালেন। এই তথ্যটি তাদের জন্য নতুন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সংবাদপত্রে সুরেশ বর্মাকে ‘শ্রমিক দরদী’ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু শম্ভু মাঝির বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুব্রতের হাতে থাকা পুরনো ছবিটি যেন এক নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দিল। “সুরেশ বর্মার কি কোনো ছেলে ছিল? বা কোনো আত্মীয়, যে সেই সময় ধর্মঘটে জড়িত ছিল?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন, তার মন দ্রুত সংযোগগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। শম্ভু মাঝি কিছুক্ষণ ভাবলেন, তার চোখ দূরে পাহাড়ের দিকে স্থির। “সুরেশ বর্মার একজন ভাগ্নে ছিল, নাম সিদ্ধার্থ। সে তখন খুবই ছোট ছিল, হয়তো দশ-বারো বছর বয়স হবে। কিন্তু সে প্রায়ই তার মামার সাথে চা বাগানে আসত। সে খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল, আর সে শ্রমিকদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছিল। সে দেখত কিভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে, কিভাবে আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার চোখে আমি এক ধরণের আগুন দেখেছিলাম, যা প্রতিশোধের আগুন হতে পারে। সে খুব চুপচাপ থাকত, কিন্তু তার চোখ দুটো সবকিছু লক্ষ্য করত।” “সিদ্ধার্থ?” অরুণিমা তার নোটবুকে নামটা দ্রুত লিখে নিলেন। এই নামটিই হয়তো তাদের দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানের শেষ বিন্দু। “সে এখন কোথায়, জানেন?” শম্ভু মাঝি মাথা নাড়লেন। “না, ম্যাডাম। ধর্মঘটের পর সুরেশ বর্মা তার ভাগ্নেকে নিয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আর তাদের কোনো খবর পাইনি। তবে সিদ্ধার্থের মুখে আমি ‘S’ অক্ষর খোদাই করা একটি ছোট লকেট দেখেছিলাম। সে সবসময় সেটা গলায় পরত। সে বলত, এটা তার মায়ের দেওয়া লকেট, তার কাছে খুব প্রিয়।” অরুণিমা এবং সুব্রত রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ‘S’ অক্ষর! সেই ধাতব কণাটিতে পাওয়া ‘S’ অক্ষরের সাথে এই তথ্যের কি কোনো সংযোগ আছে? এটি কেবল একটি কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না। এই ‘S’ অক্ষরটি কি সিদ্ধার্থের ‘স্বাক্ষর’? তার প্রতিশোধের প্রতীক? “শম্ভু বাবু, আপনার দেওয়া তথ্য আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” অরুণিমা বললেন, তার কণ্ঠে এক ধরণের কৃতজ্ঞতা। “আপনি কি সিদ্ধার্থের কোনো ছবি বা তার সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দিতে পারবেন? তার স্কুলের নাম, তার বন্ধুদের নাম, বা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের কথা?” শম্ভু মাঝি দুঃখিত মুখে বললেন, “না, ম্যাডাম। আমার কাছে তার কোনো ছবি নেই। আর এত বছর পর তার সম্পর্কে আর কিছু মনে নেই। তবে আমি জানি, সে খুব মেধাবী ছিল। সে হয়তো প্রতিশোধের জন্য ফিরে এসেছে। এই পাহাড়ের মাটি অনেক রক্ত দেখেছে, ম্যাডাম। পুরনো পাপের ফল সবসময়ই ভোগ করতে হয়।” অরুণিমা এবং সুব্রত রায় শম্ভু মাঝির কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তাদের মনে এক নতুন রহস্যের জাল বোনা শুরু হয়েছে। সিদ্ধার্থ বর্মা। ‘S’ অক্ষর। পুরনো প্রতিশোধ। এই সব তথ্য যেন এক নতুন গল্পের সূচনা করছিল। মৌন উপত্যকার গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই পুরনো ক্ষত এবার উন্মোচিত হতে শুরু করেছে, যা দার্জিলিংয়ের শান্ত পরিবেশে এক নতুন ঝড় তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অরুণিমা অনুভব করলেন, তারা অপরাধীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। এখন শুধু তাকে খুঁজে বের করার পালা। (চলবে )  

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion