মুখোশের আড়ালে
শম্ভু মাঝির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো অরুণিমা এবং সুব্রত রায়কে এক নতুন দিশা দেখাল। ‘S’ অক্ষর খোদাই করা ধাতব কণা এবং সিদ্ধার্থ বর্মার গলায় থাকা ‘S’ অক্ষরের লকেট – এই দুটি তথ্যের মধ্যেকার সংযোগ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে এটিকে আর কাকতালীয় বলা যাচ্ছিল না। অরুণিমার মনে হলো, তারা অবশেষে রহস্যের মূল সুতোটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু একই সাথে, তাদের উপর চাপ আরও বাড়ছিল। কলকাতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে প্রতিনিয়ত ফোন আসছিল, সংবাদমাধ্যমগুলো “সিরিয়াল কিডন্যাপিং” নিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর খবর পরিবেশন করছিল, এবং দার্জিলিংয়ের মানুষজন রীতিমতো আতঙ্কিত ছিল। শহরের পর্যটন শিল্পে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছিল, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করছিল।
থানায় ফিরে অরুণিমা তৎক্ষণাৎ সুব্রত রায়কে নির্দেশ দিলেন, “ইন্সপেক্টর, সিদ্ধার্থ বর্মা সম্পর্কে যত তথ্য পাওয়া যায়, সব সংগ্রহ করুন। ওর মামা সুরেশ বর্মার পুরনো ঠিকানা, সিদ্ধার্থের জন্ম তারিখ, তার স্কুলের রেকর্ড, কলেজের রেকর্ড – সবকিছু। বিশেষ করে, সে দার্জিলিং ছেড়ে যাওয়ার পর কোথায় গিয়েছিল, কী পড়াশোনা করেছে, কী কাজ করত, তার বর্তমান ঠিকানা – এই সব তথ্য আমাদের দরকার।”
সুব্রত রায় মাথা নেড়ে দ্রুত কাজে লেগে পড়লেন। কলকাতা পুলিশের সদর দফতরে যোগাযোগ করা হলো, পুরনো রেকর্ডপত্র ঘাঁটার জন্য। দার্জিলিংয়ের পুরনো স্কুল এবং কলেজের রেজিস্টারগুলোও পরীক্ষা করা শুরু হলো। প্রতিটি লাইব্রেরি, প্রতিটি পুরনো নথি ঘেঁটে দেখা হচ্ছিল। সিদ্ধার্থের বয়স এখন প্রায় ৩১-৩৩ বছর হবে, এই বয়সের একজন ব্যক্তি যদি এত বছর ধরে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে তার মনস্তত্ত্ব কেমন হতে পারে, তা অরুণিমা ড. প্রবীর মিত্রের সাথে আলোচনা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি জানতেন, এই ধরনের অপরাধীরা সাধারণ অপরাধী নয়, তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
পরের দিন সকালে, অরুণিমা আবার ড. মিত্রের বাড়িতে গেলেন। তিনি শম্ভু মাঝির কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত তথ্য ড. মিত্রকে জানালেন। সিদ্ধার্থের নাম, তার মামা সুরেশ বর্মার ভণ্ডামি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – সিদ্ধার্থের ‘S’ অক্ষরের লকেট। ড. মিত্রের সামনে তিনি একটি সাদা বোর্ড স্থাপন করলেন এবং তাতে প্রিয়াঙ্কা, রাহুল, মুখার্জী পরিবার, বর্মা পরিবার, ১৯৭৯ সালের ধর্মঘট, শম্ভু মাঝি, এবং সিদ্ধার্থের নামগুলো লিখে একটি ‘কানেকশন ম্যাপ’ তৈরি করলেন। ম্যাপটি যত সম্পূর্ণ হচ্ছিল, তত যেন অপরাধীর চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
ড. মিত্র মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার চোখে এক ধরণের গভীর চিন্তার ছাপ। “সিদ্ধার্থ বর্মা… এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত। একজন শিশু যখন তার চোখের সামনে এমন ভয়াবহতা দেখে, তার পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখে, তখন তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষত যদি সময়ের সাথে সাথে নিরাময় না হয়, তাহলে তা প্রতিশোধের আগুনে পরিণত হতে পারে। এই ধরনের প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা সময়ের সাথে সাথে আরও তীব্র হয়, এবং ব্যক্তি আরও বেশি হিসেবী ও নির্মম হয়ে ওঠে। সে তার প্রতিশোধকে একটি শিল্পকর্ম মনে করে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ নিখুঁত হতে হবে।”
তিনি আরও বললেন, “এই ধরনের অপরাধীরা সাধারণত খুব ধৈর্যশীল হয়। তারা তাদের শিকারকে খুব সাবধানে নির্বাচন করে। প্রিয়াঙ্কা মুখার্জী এবং রাহুল বর্মা – এরা দুজনেই সেই পুরনো ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত না হলেও, তাদের পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তারা অপরাধীর লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। অপরাধী সম্ভবত এই পরিবারগুলোকে তাদের অতীত পাপের জন্য শাস্তি দিতে চাইছে, এবং তাদের সন্তানদের অপহরণ করে তাদের মানসিক যন্ত্রণা দিতে চাইছে। সে চায় এই পরিবারগুলো ঠিক তেমনই অসহায় বোধ করুক, যেমনটা তার পরিবার ১৯৭৯ সালে অনুভব করেছিল। সে তাদের উপর ঠিক সেই ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে চায়, যা তার উপর সৃষ্টি হয়েছিল।”
“কিন্তু কেন এই ‘S’ অক্ষর?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন। “এটা কি শুধু তার নামের প্রথম অক্ষর, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর অর্থ আছে?”
ড. মিত্র বললেন, “এটি তার পরিচয়ের একটি অংশ, যা সে তার অপরাধের সাথে যুক্ত করেছে। এটি তার ‘স্বাক্ষর’, যা সে গর্বের সাথে রেখে যাচ্ছে। এটি তার প্রতিশোধের প্রতীক, যা সে চায় তার শিকাররা বুঝতে পারুক। এই ‘S’ হয়তো ‘শাস্তি’ (Punishment) বা ‘শয়তান’ (Devil) এর প্রতীকও হতে পারে, যা সে নিজেকে মনে করে, অথবা যা সে এই পরিবারগুলোকে মনে করে। অথবা, এটি ‘শান্তি কুঞ্জ’ চা বাগানের ‘শান্তি’ শব্দের ‘S’ হতে পারে, যার শান্তি সে ভেঙে দিতে চাইছে। এটি একটি প্রতীকী বার্তা, যা সে সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে।” ড. মিত্রের এই নতুন ব্যাখ্যা অরুণিমাকে আরও ভাবিয়ে তুলল।
ঠিক তখনই সুব্রত রায়ের ফোন এলো। “ম্যাডাম, সিদ্ধার্থ বর্মা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি! সুরেশ বর্মা দার্জিলিং ছাড়ার পর তার ভাগ্নে সিদ্ধার্থকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধার্থ একটি নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে। সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল, প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করত। তার শিক্ষকদের মতে, সে ছিল একজন জিনিয়াস, যার মেধা ছিল অসাধারণ। তারপর সে কলকাতায় একটি ঘড়ি তৈরির কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেছিল, যেখানে উচ্চমানের সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ তৈরি করা হতো। সেই কোম্পানি টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু ব্যবহার করত! তার কাজের রেকর্ডও ছিল নিঁখুত, কোনো ভুল ছিল না। তার সহকর্মীরা তাকে ‘সাইলেন্ট জিনিয়াস’ বলত, কারণ সে খুব কম কথা বলত কিন্তু তার কাজ ছিল অসাধারণ।”
অরুণিমা এবং ড. মিত্র একে অপরের দিকে তাকালেন। সব কিছু যেন এক সুতোয় বাঁধা পড়ছিল। ‘S’ অক্ষর, টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু, সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ, এবং সিদ্ধার্থের ঘড়ি তৈরির কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা – সব মিলে যাচ্ছিল। তার ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান এবং সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ তৈরির অভিজ্ঞতা তাকে এই ধরনের জটিল অপহরণ পরিকল্পনা করতে সাহায্য করেছে। সে হয়তো নিজেই এই ধাতব কণাগুলো তৈরি করেছে, তার নিজস্ব স্বাক্ষর হিসেবে।
“আর তার বর্তমান ঠিকানা?” অরুণিমা দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন।
“তার শেষ পরিচিত ঠিকানা ছিল কলকাতার একটি ফ্ল্যাট। কিন্তু সে প্রায় এক বছর আগে সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছে। তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই,” সুব্রত রায় বললেন। “তবে আমরা তার পুরনো পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। তার কলেজ এবং কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের সাথে কথা বলছি। আমরা জানতে পেয়েছি, সে খুব একা থাকতে পছন্দ করত, কারো সাথে বেশি মিশত না।”
অরুণিমা ফোন রেখে ড. মিত্রের দিকে ফিরলেন। “ডাক্তার সাহেব, সিদ্ধার্থ বর্মা। সে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ঘড়ি তৈরির কোম্পানিতে কাজ করত, যেখানে টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু ব্যবহার করা হতো। সবকিছু মিলে যাচ্ছে। তার মানে, এই অপহরণগুলো তার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতারই প্রমাণ। সে শুধু প্রতিশোধ নিতে চায় না, সে চায় তার প্রতিশোধ যেন নিখুঁত হয়, যেন এটি একটি মাস্টারপিস হয়।”
ড. মিত্রের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। “একজন বুদ্ধিমান এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ অপরাধী। তার প্রতিশোধের পরিকল্পনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল। সে জানে কিভাবে কোনো চিহ্ন না রেখে কাজ করতে হয়, এবং কিভাবে তার শিকারদের মানসিক যন্ত্রণা দিতে হয়। সে হয়তো দার্জিলিংয়ে ফিরে এসেছে, এবং তার পুরনো ক্ষতগুলো থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছে। সে হয়তো এই পরিবারগুলোর প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে, তাদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করছে, তাদের জীবনকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করতে চাইছে।”
“তার মানে, সে হয়তো দার্জিলিংয়েই লুকিয়ে আছে,” অরুণিমা বললেন, তার চোখে এক ধরণের দৃঢ় সংকল্প। “শহরের কোথাও, যেখানে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। এমন কোনো জায়গায়, যা তার অতীতের সাথে সম্পর্কিত, অথবা যেখানে সে সহজে লুকিয়ে থাকতে পারে। হয়তো কোনো পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ি, যা তার শৈশবের স্মৃতি বহন করে, অথবা যেখানে সে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।”
“ঠিক তাই,” ড. মিত্র বললেন। “সে হয়তো এমন কোনো ছদ্মবেশে আছে, যা তাকে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে সাহায্য করছে। সে হয়তো কোনো ছোটখাটো কাজ করছে, যা তাকে এই শহরের উপর নজর রাখতে সাহায্য করছে। হয়তো সে একজন সাধারণ দোকানদার, বা একজন পর্যটক গাইড, অথবা কোনো চা বাগানের কর্মচারী। এমন কেউ যাকে কেউ সন্দেহ করবে না, কিন্তু যে সবার উপর নজর রাখতে পারে, এবং তার শিকারদের উপর নজর রাখতে পারে।”
অরুণিমা এবং সুব্রত রায় সিদ্ধার্থ বর্মার অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করলেন। তারা দার্জিলিংয়ে সিদ্ধার্থের সম্ভাব্য লুকানোর জায়গাগুলো খুঁজতে লাগলেন। পুরনো বাড়ি, নির্জন কটেজ, বা এমনকি চা বাগানের পরিত্যক্ত বাংলো – প্রতিটি সম্ভাব্য স্থান খতিয়ে দেখা শুরু হলো। শহরের প্রতিটি গেস্ট হাউসের রেজিস্টার, প্রতিটি নতুন আসা মানুষের তথ্য পরীক্ষা করা হচ্ছিল। পুলিশ সাদা পোশাকে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নজরদারি শুরু করল। তারা সিদ্ধার্থের সম্ভাব্য মানসিক অবস্থা এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ড. মিত্রের সাথে প্রতিনিয়ত আলোচনা করতে লাগলেন। তাদের মনে হচ্ছিল, অপরাধী তাদের খুব কাছাকাছিই আছে, কিন্তু সে এক অদৃশ্য মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে, যা ধীরে ধীরে ভেদ করা কঠিন। মৌন উপত্যকা যেন তার সমস্ত রহস্য উন্মোচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, আর অরুণিমা অনুভব করলেন, এই নীরবতা ভাঙার সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক তীব্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছিল, যেখানে সময় ছিল তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
(চলবে )
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion