পরের দিন সকালে আনিক ঘুম থেকে উঠল। তার বিছানা, তার ঘরের পরিচিত গন্ধ। বাইরে সূর্যের আলো। এবার আর তার ঘুম ভাঙেনি বুকফাটা প্রত্যাশা নিয়ে, বরং এসেছে এক তীব্র স্বস্তি নিয়ে। সেদিন রাতে সে আর সেই স্বপ্ন দেখল না। স্বপ্নলোকের দরজা আর তাকে হাতছানি দিল না।
আনিক চাকরি ছেড়ে দিল। সে আর কখনোই পুরোনো বা পরিত্যক্ত ভবনের কাছে যায় না। কিন্তু সে জানে, সেই রহস্যময় জগৎ, সেই শব্দহীন বাস্তব, তার থেকে মাত্র একটা আলমারির দূরত্বে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মগুলো পাল্টে গেছে। আনিক এখন যখনই কোনো নীরব, অন্ধকার করিডোরে হাঁটে, তখনই সে ভয় পায়, আবার সেই বেগুনি আভা দেখতে পাবে কিনা।
কিন্তু সে জানত, কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সে কেবল পালিয়ে এসেছে, সমস্যার সমাধান হয়নি। সেই দরজাটা, সেই পোর্টালটা এখনও খোলা আছে।
দু’মাস কেটে গেল। আনিক শহর থেকে দূরে, একটি পাহাড়ি এলাকার ছোট কুটিরে আশ্রয় নিয়েছে। সে কেবল শব্দ আর আলোর আড়ালে বাঁচতে চেয়েছিল।
একদিন সকালে, খবর কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে সে চমকে উঠল। 'প্রাচীন পান্ডুলিপি ভবন'-এ একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। একজন নৈশ প্রহরীকে নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল প্রহরীর শেষ কার্যকলাপের বর্ণনা— সে তার শেষ টহলে একটি প্রাচীন আলমারিকে তার নির্দিষ্ট স্থান থেকে প্রায় এক ফুট সরিয়ে রেখেছিল।
আনিকের শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। আলমারি সরেছে মানে দরজাটা উন্মুক্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
অগত্যা, তাকে ফিরতে হলো। তাকে আবার কলকাতায় ফিরতে হলো, কিন্তু এবার সে শুধু পালিয়ে আসতে নয়, বরং রহস্যের উৎস খুঁজে বের করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
লাইব্রেরিতে ফিরে গিয়ে আনিক আর্কিভিস্টের পরিচয় ব্যবহার করে আবার সেই সংরক্ষিত কক্ষে প্রবেশ করলো। আলমারিটা এখনও একটু সরে আছে। সে আলমারিটা সরালো। সেই করিডোর! বেগুনি আভা এখনও জ্বলছে।
এবার সে করিডোরে প্রবেশ করলো না। বরং সে লাইব্রেরির পুরোনো নথিগুলো ঘাঁটতে শুরু করলো, যা সে আগে স্ক্যান করার জন্য প্রস্তুত করেছিল। সে খুঁজছিল সেই দরজার ইতিহাস।
তিন দিন ধরে রাত জেগে কাজ করার পর সে খুঁজে পেল একটি জীর্ণ চামড়ার মলাটের ডায়েরি। ডায়েরিটি ১৮৯৩ সালে লেখা এবং এর লেখক ছিলেন লাইব্রেরির তৎকালীন প্রধান সংগ্রাহক, ডঃ সোমেশ্বর মিত্র।
ডায়েরির প্রথম পাতাগুলো ছিল ডঃ মিত্রের তীব্র দার্শনিক অনুসন্ধানের ফল। তিনি লিখেছেন: "মানব জীবন এক নিরবচ্ছিন্ন কোলাহল। প্রতিটি শব্দই এক একটি মিথ্যা, যা আমাদের ভেতরের সত্যকে ঢেকে রাখে। আমি এমন এক বিশুদ্ধ স্থান চেয়েছিলাম, যেখানে আত্মা শব্দ-মুক্ত হয়ে নিঃশব্দের পরম শান্তি লাভ করবে।"
কিন্তু এই দার্শনিক অনুসন্ধানই কীভাবে এক বৈজ্ঞানিক উন্মাদনায় পরিণত হলো, তা পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে স্পষ্ট।
"আমি শব্দকে ঘৃণা করি। এই জগৎ শব্দ দ্বারা দূষিত। আমি এমন একটি জগত তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেখানে নিঃশব্দের পরম শান্তি বিরাজ করবে। আমি সেই দরজাটি তৈরি করেছিলাম... স্থান এবং কালের একটি ত্রুটি ব্যবহার করে...। আমি এই ছিদ্রটিকে এমন এক সমান্তরাল মাত্রার দিকে খুলে দিয়েছি, যেখানে ধ্বনির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিপরীত শক্তি দ্বারা শোষিত হয়। আর সেই শোষণের ফল হলো শব্দহীন প্রাণীগুলো। তারা শব্দের প্রতি এতটাই সংবেদনশীল যে আমাদের সামান্যতম কথা বা নিঃশ্বাসও তাদের কাছে তীব্র যন্ত্রণার কারণ।"
সোমেশ্বর আরও লিখেছেন: "আমি প্রতিশব্দকে তৈরি করেছিলাম রক্ষক হিসেবে, সে এমন এক সত্তা যা ধ্বনিকে অনুভব করতে পারে কিন্তু নিজে কোনো শব্দ তৈরি করে না। তার কাজ ছিল ছিদ্রটিকে বন্ধ রাখা। কিন্তু ছিদ্রটি বন্ধ করার আসল চাবি... তা আমার সূত্রগুলোতে কোথাও লুকিয়ে আছে।"
আনিকের চোখে সব স্পষ্ট হয়ে গেল। সেই দরজা কোনো স্বপ্নলোকের দরজা ছিল না, তা ছিল ডঃ সোমেশ্বর মিত্রের এক বিস্ফোরক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যা অন্য একটি জগতকে বাস্তবের সাথে জুড়ে দিয়েছে। স্বপ্নটা ছিল আসলে তার অবচেতন মনকে সেই ছিদ্রের কাছাকাছি টেনে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া।
ডায়েরির শেষ পাতার একটি রহস্যময় নকশা আনিকের চোখ টানলো। নকশাটি ছিল একটি জটিল যন্ত্রের, যার নিচে ছোট করে লেখা: 'ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র'। যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা পুরনো দিনের একটি গ্রামোফোনের মতো, যার সঙ্গে যুক্ত আছে দুটি ক্রিস্টালের স্পিকার।
ডায়েরিটি পড়ার পর আনিক নিশ্চিত হলো— এই দরজা বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো সেই যন্ত্রটি খুঁজে বের করা এবং সেটিকে শব্দহীন জগতের ভেতরে ব্যবহার করা। কিন্তু এর অর্থ হলো তাকে আবার সেই ভয়ঙ্কর জগতে প্রবেশ করতে হবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion