আনিক এবার আর তাড়াহুড়ো করলো না। সে তার আর্কিভিস্টের বুদ্ধি এবং সোমেশ্বর মিত্রের সূত্র কাজে লাগাতে শুরু করলো।
প্রথমে, সে লাইব্রেরির গোপন কোড এবং নথিপত্র ব্যবহার করে 'ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র'-এর ক্রিস্টালের সূত্র খুঁজে বের করলো। সূত্র অনুযায়ী, যন্ত্রটি তৈরি করতে দরকার বিশেষ ধরণের কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল, যা উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ শোষণ এবং নির্গমন করতে পারে।
আনিক স্থানীয় বাজার এবং ইলেকট্রনিক স্ক্র্যাপ ডিলারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যোগাড় করলো। সে তার নিজের ঘরে বসে ডঃ মিত্রের আঁকা নকশা অনুযায়ী একটি ছোট, বহনযোগ্য ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র তৈরি করলো। যন্ত্রের মূল কাজ ছিল— এক তীব্র, তীক্ষ্ণ, উচ্চ-কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করা যা ‘শব্দহীন’দের স্বাভাবিক গতিকে স্তব্ধ করে দেবে।
ফেরার দিন স্থির হলো।
কিন্তু তার আগেই, একদিন গভীর রাতে, আনিক তার ঘরের দরজায় ক্ষীণতম আওয়াজ শুনতে পেল। শব্দটি এতটাই কম যে ইয়ারপ্লাগ লাগানো না থাকলে হয়তো শুনতেই পেত না।
সে নিঃশব্দে দরজার ছিদ্র দিয়ে বাইরে তাকালো।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটি 'শব্দহীন' মূর্তি।
আনিকের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সে তো আলমারি সরিয়ে দিয়ে আসেনি! তবে কি দরজাটি আপনা-আপনি খুলে গেছে? নাকি কোনো 'শব্দহীন' কোনোভাবে পালিয়েছে?
মূর্তিটি সম্পূর্ণ সাদা নয়, বরং ফ্যাকাসে ছাই রঙের। এটি পূর্ণাঙ্গ 'শব্দহীন' নয়, যেন অর্ধেক তৈরি হওয়া কোনো সত্তা— যাকে বিমল পরে 'শিশুসত্তা' বলে উল্লেখ করবেন। এর আকারও ছোট, সম্ভবত একটি ১২-১৩ বছরের শিশুর মতো।
আনিক দেখল, ‘শব্দহীন’ শিশুটির মসৃণ মুখমণ্ডলে একটি ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যেখান থেকে সামান্য বেগুনি আভা বের হচ্ছে। এই ফাটলটি যেন বাস্তবতার সাথে তার সংযোগের ফল। সেটি তার দরজার কপাটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে, তার হাতে থাকা ধাতব বস্তু দিয়ে কপাটে আঘাত করছে। কিন্তু শব্দটি এত কম, যেন কেউ তুলো দিয়ে চাপ দিচ্ছে।
আনিকের মনে পড়লো সোমেশ্বর মিত্রের কথা: "ছিদ্রের ওপারে সব শব্দ তার বিপরীত শক্তি দ্বারা শোষিত হয়।" এই শিশু-শব্দহীনটা বাস্তবের শব্দ সহ্য করতে না পেরে চেষ্টা করছে অতি ক্ষীণ ধ্বনি তৈরি করতে, যা তার নিজের জগতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে। তার ফাটলগুলো প্রমাণ করে, এই জগতে প্রবেশ করা সত্তাদের জন্য বাস্তবতার শব্দ কতটা যন্ত্রণাদায়ক।
আনিক বুঝতে পারলো— কেবল তার জীবন নয়, এখন এই বাস্তব জগৎও বিপন্ন। যদি এই শিশু-শব্দহীনটা পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করে বা আরও সত্তাদের প্রবেশদ্বার খুলে দিতে পারে, তবে গোটা কলকাতা শব্দহীন জগতে পরিণত হতে পারে।
তাকে এখনই যেতে হবে।
সে তার ধ্বনিনির্গমন যন্ত্রটি তার পিঠে ঝোলালো। পকেটে রাখল কিছু পাওয়ার ব্যাংক, আর হাতে টর্চ। সে জানে, এই জগতে আলোর কোনো মূল্য নেই, কিন্তু অন্ধকারে সে অভ্যস্ত নয়।
সে নিঃশব্দে পেছনের জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল এবং লাইব্রেরির দিকে ছুটলো।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion