লাইব্রেরিতে ফিরে এসে আনিক আলমারি সরালো। বেগুনি আভা তাকে স্বাগত জানালো। এইবার আনিকের মনে ভয় ছিল না, ছিল এক শীতল সংকল্প।
সে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
দ্বিতীয়বার প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। এবার সে চত্বরে নামলো না, বরং দ্রুত একটি ভাঙা দালানের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার ধ্বনিনির্গমন যন্ত্রের একটি ছোট স্পিকার তার হাতে ছিল।
আনিক দেখল, প্রথমবার সে যেখানে নেমেছিল, সেই চত্বরটি এখন আরও বেশি 'শব্দহীন' দ্বারা পূর্ণ। তারা হয়তো তাদের সঙ্গীটির অন্তর্ধান টের পেয়েছে, বা তারা কোনো নির্দেশ পেয়েছে।
আনিক সোমেশ্বর মিত্রের ডায়েরির নকশাগুলো মনে করলো। ডায়েরিতে একটি মানচিত্র আঁকা ছিল, যা এই শহরের বিন্যাস নির্দেশ করছিল। সেই মানচিত্র অনুযায়ী, ‘ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র’-এর চাবি লুকিয়ে আছে শহরের একদম কেন্দ্রে, যা পরিচিত ছিল 'মৌন মিনার' নামে। মিনারটি ছিল এই জগতের শব্দ-শোষণের শক্তির উৎস।
মৌন মিনারের দিকে যেতে হলে তাকে শহরের ধ্বংসাবশেষ ভেদ করে যেতে হবে।
আনিক দেওয়াল ঘেঁষে সন্তর্পণে এগিয়ে চলল। চারপাশে পার্পল আলো, বিকৃত গাছপালা আর মরচে পড়া লোহার তীব্র গন্ধ। সে দেখল, কিছু ‘শব্দহীন’ মাটি থেকে ছোট, পাথর সদৃশ বস্তু কুড়িয়ে খাচ্ছে। বস্তুগুলো সম্ভবত শব্দের বিপরীত শক্তি, যা এই জগতে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়— যেন নিস্তব্ধতাই তাদের একমাত্র পুষ্টি।
হঠাৎ আনিক দেখল, একটি ভাঙা ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। এই জগতে আলো বিরল। কৌতূহলী হয়ে সে ভেতরে প্রবেশ করলো।
ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে একজন মানুষ বসে আছে!
তিনি খুবই বৃদ্ধ, তার শরীর জীর্ণ, কিন্তু স্পষ্টতই মানুষ। তিনি একটি ভাঙা চেয়ারে বসেছিলেন এবং তার হাতে ছিল একটি ছোট রেডিওর মতো যন্ত্র। যন্ত্রটি থেকে খুব মৃদু, প্রায় অস্পষ্ট এক ধরণের গুঞ্জন শব্দ বের হচ্ছিল। এই শব্দটি 'শব্দহীন'দের অসহনীয় তীক্ষ্ণ শব্দের চেয়ে আলাদা, এটি ছিল এক শান্ত, স্থিতিশীল ধ্বনি।
আনিক সতর্কতার সাথে তার দিকে এগিয়ে গেল।
"কে আপনি?" আনিক বাংলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো।
বৃদ্ধ মানুষটি তার দিকে তাকালেন। তার চোখগুলো গভীর, ক্লান্ত।
"সোমেশ্বর... মিত্রের নাম শুনেছ?" বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তার কণ্ঠস্বর ভাঙা কাঁচের মতো।
আনিক চমকে গেল। "আপনি? আপনি কে?"
"আমি বিমল," বৃদ্ধ বললেন। "সোমেশ্বরের সহকারী। আমিই সেই প্রথম মানুষ, যে তার সাথে এই জগতে প্রবেশ করেছিল। আমি ফিরে যেতে পারিনি। কিন্তু আমি 'শব্দহীন' হইনি।"
বিমল ব্যাখ্যা করলেন, "যখন সোমেশ্বর দরজাটা খোলেন, তখন তীব্র শব্দ-শোষণ প্রক্রিয়ার ফলে আমি এবং এই শহরের বাকি মানুষগুলো ধীরে ধীরে শব্দহীন-এ রূপান্তরিত হতে থাকি। এটি এক ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া। প্রথমে শব্দ ফুরিয়ে যায়, তারপর স্মৃতি, তারপর মুখের পেশীগুলো শক্ত হয়ে মসৃণ চামড়ায় পরিণত হয়। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, আমি সময় মতো একটা স্থির শব্দ-উৎস (Stable Sound Source) তৈরি করতে পেরেছিলাম। এই গুঞ্জন যন্ত্র আমাকে সম্পূর্ণ বিলীন হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। আমি হলাম এক 'প্রতিধ্বনি' (Echo), এই জগতে বেঁচে থাকা শেষ মানুষ।"
বিমল আনিককে দেখালেন: তাঁর মুখের চামড়ার প্রান্তে ছোট ছোট ফাটল তৈরি হয়েছে, ঠিক যেন সেই শিশু-শব্দহীনের মতো। এই জগৎ তাকেও ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে।
"সোমেশ্বর পালানোর আগে একটি যন্ত্রের কথা বলেছিলেন— ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র," আনিক বলল। "আমি সেটা তৈরি করে এনেছি।"
বিমল মাথা নেড়ে হাসলেন। "সোমেশ্বর ভেবেছিলেন যন্ত্রই সব। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই জগতে প্রতিশব্দ-এর ভূমিকা কী।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion