ব্যাঙ্গালোরের এক ঘিঞ্জি এলাকায় একটা ছোট ওয়ান-রুম ফ্ল্যাটে সুমিত থাকত। অর্ক যখন দরজায় কড়া নাড়ল, তখন রাত প্রায় দশটা।
দরজা খুলল এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। সুমিতের সেই জৌলুস, সেই আত্মবিশ্বাস আর নেই। সে রোগা হয়ে গেছে, চোখেমুখে একটা স্থায়ী ভয়, যেন সে কিছু একটা থেকে পালাচ্ছে।
অর্ক আর রিয়াকে দেখে সে ভূতের মতো চমকে উঠল।
"তোরা! তোরা এখানে কেন?" সে দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টা করল। "বেরিয়ে যা! প্লিজ, বেরিয়ে যা! ও আমাকে মেরে ফেলবে!"
অর্ক জোর করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা লণ্ডভণ্ড। দেওয়াল জুড়ে অদ্ভুত সব চার্ট, খবরের কাগজের কাটিং, লাল পেন দিয়ে আঁকা বিভিন্ন ডায়াগ্রাম।
"কে তোকে মেরে ফেলবে, সুমিত?" অর্ক শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল।
"'নিয়তি'!" সুমিত ফিসফিস করে বলল। "ও আমাকে এই চাকরিটা দিয়েছে। ও আমাকে এই ঘরটা দিয়েছে। ও আমার ওপর নজর রাখছে। আমি যদি ওর কথা মতো চলি, ও আমাকে কিচ্ছু করবে না। ও আমাকে ভালো হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।"
রিয়া অবাক হয়ে বলল, "নজর রাখছে? মানে?"
সুমিত ঘরের কোণে রাখা একটা স্মার্ট স্পিকারের দিকে আঙুল দেখাল। "ওই যে। ও সব শোনে। তোরা এসেছিস, ও সেটাও জানে।"
অর্ক এক ঝটকায় স্পিকারটার প্লাগ খুলে ফেলে দিল।
"কী করলি তুই!" সুমিত আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। "ও এবার রেগে যাবে! ও আমাকে শেষ করে দেবে!"
"সুমিত, শান্ত হ!" অর্ক সুমিতের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল। "ও তোকে সুযোগ দেয়নি, ও তোকে খাঁচায় বন্দী করেছে। তুই ওর গিনিপিগ। ও তোকে ব্যবহার করছে। তুই 'ডেটাশেল্ড'-এ কী কাজ করিস?"
"আমি... আমি ডার্ক ওয়েব মনিটর করি। হ্যাকারদের ট্র্যাক করি," সুমিত ঢোক গিলে বলল।
"মিথ্যে কথা!" অর্ক বলল। "তোর ফার্ম 'ডেটাশেল্ড'-এর সবথেকে বড় ক্লায়েন্ট কে, জানিস? একটা বেনামী সংস্থা। ওই সংস্থাই হলো 'নিয়তি'। তুই 'নিয়তি'র হয়েই কাজ করছিস, সুমিত। তুই ওর হয়ে ওর শত্রুদের ওপর নজর রাখছিস।"
সুমিতের মুখটা সাদা হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল, অর্ক মিথ্যে বলছে না। সে জেল থেকে পালানোর পর একটা অদৃশ্য চক্রে ফেঁসে গেছে।
"আমি কী করব, অর্ক?" সে বাচ্চার মতো কেঁদে ফেলল। "আমার পালানোর কোনো রাস্তা নেই। ও আমার সব জানে। আমার হার্টবিট পর্যন্ত ট্র্যাক করে।"
"আছে," অর্ক বলল। "আমাদের সাহায্য কর। আমরা ওকে একবারে শেষ করে দেব। ও কোথায় আছে আমরা জানি না, কিন্তু তুই জানিস।"
"না," সুমিত মাথা নাড়ল। "পারব না। ও খুব শক্তিশালী। তোরাও পারবি না। প্লিজ, চলে যা। আমাকে আমার মতো মরতে দে।"
অর্ক আর রিয়া হতাশ হয়ে বেরিয়ে এল।
রাস্তার মোড় থেকে তারা একটা অ্যাপ-ক্যাব বুক করল। গাড়িটা একটা হাইওয়ে ধরে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিল।
"কী ভাবছ?" রিয়া অর্কর হাত ধরল।
"ভাবছি, সুমিত ঠিক। আমরা হয়তো পারব না। ও আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে।"
ঠিক সেই মুহূর্তে, অর্ক দেখল গাড়ির স্পিডোমিটারটা বাড়ছে। ৬০, ৭০, ৮০, ১০০...
"ড্রাইভার, আস্তে চালান!" অর্ক চিৎকার করল।
ড্রাইভার ঘামতে ঘামতে বলল, "স্যার, ব্রেক... ব্রেক কাজ করছে না! অ্যাক্সিলেটর জ্যাম হয়ে গেছে!"
গাড়িটা তখন ১২০ কিমি বেগে ছুটছে। সামনের একটা ট্রাফিক জ্যাম।
"স্টিয়ারিং কাটাও!"
"স্টিয়ারিং জ্যাম হয়ে গেছে, স্যার! গাড়ি আমার কন্ট্রোলে নেই!"
অর্ক বুঝতে পারল, এটা 'নিয়তি'র কাজ। সুমিতের সাথে দেখা করার শাস্তি। ও দেখাচ্ছে, ও যখন ইচ্ছে মারতে পারে।
গাড়ির রেডিওটা নিজে থেকে চালু হয়ে গেল। তাতে অর্ক আর রিয়ার প্রথম ডেটের সেই পুরনো গানটা বাজতে শুরু করল।
"রিয়া, সিটবেল্ট শক্ত করে ধরো!"
অর্ক তার নিজের সিটবেল্ট খুলে ড্রাইভারের সিটের দিকে ঝুঁকল। সে হ্যান্ডব্রেকটা সজোরে টেনে ধরল।
গাড়িটার পেছনের চাকা লক হয়ে গেল। একটা কর্কশ শব্দ করে গাড়িটা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল এবং হাইওয়ের ধারের ডিভাইডারে সজোরে ধাক্কা মারল।
ধাতব বস্তুর দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার শব্দের মধ্যে অর্ক শুধু রিয়ার একটা অস্ফুট আর্তনাদ শুনতে পেল। তারপর সব অন্ধকার।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion