দলের মধ্যে একটা স্পষ্ট ফাটল দেখা দিল। তনয়া ল্যাবে আসা বন্ধ করে দিল। তার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। রিয়া অর্ককে সন্দেহ করতে শুরু করল, অর্ক রিয়াকে। একমাত্র সুমিত ছিল নির্বিকার। সে ব্যস্ত ছিল ইনভেস্টরদের নিয়ে। তার কাছে এগুলো ছিল ছোটখাটো সমস্যা।
"আরে বাদ দে না," সুমিত একদিন অর্ককে বলল। "তনয়া জেলাস ফিল করছিল, তাই ওসব বলেছে। ও বুঝতে পারছিল, এই প্রজেক্টের আসল স্টার তুই আর আমি। তাই ও প্রফেসরকে গিয়ে কান ভাঙিয়েছে। আমরা অ্যাপটা থেকে ওর শেয়ার রিমুভ করে দেব। আর রিয়া, তুইও বড্ড বেশি ভাবছিস। অ্যাপটা হিট, মানুষ এটা পছন্দ করছে। ব্যস।"
"পছন্দ করছে? নাকি ভয় পাচ্ছে?" রিয়া পাল্টা প্রশ্ন করল। "লোকেরা এখন অ্যাপ না দেখে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না, সুমিত। এটা স্বাস্থ্যকর নয়।"
ঠিক সেই সময়েই ক্যাম্পাসের আর এক পরিচিত মুখ, রোহন, তার বন্ধুদের সাথে বাজি ধরল। রোহন ছিল বেপরোয়া বাইক রেসার, অ্যাডrenaline জাঙ্কি। তার ফোনে 'নিয়তি' নোটিফিকেশন দিল: "আজ রাত ১০টায় বাইপাসের মোড়ে তোমার বাইক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভাঙবে। একটা লাল ট্রাক তোমাকে ধাক্কা মারবে। মেন রোড এড়িয়ে চলো।"
রোহন তার বন্ধুদের সামনে অট্টহাসি হেসে উঠল। "দেখলি? এই অ্যাপটা একটা জোকার। ও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে! আজ রাত ঠিক দশটায় আমি বাইপাসের ওই মোড় দিয়েই ফুল স্পিডে যাব। দেখি কোন লাল ট্রাক আমার পা ভাঙে! আমি তোদের জন্য ভিডিও তুলব।"
তার বন্ধুরা তাকে বারণ করেছিল। "ভাই, রিস্ক নিস না। অ্যাপটা কিন্তু ভুল বলে না।"
"আরে ধুর! আমি আমার নিয়তি নিজে লিখি!" রোহন জেদি ছিল।
রাত ন'টা পঞ্চান্ন। রোহন তার বাইক স্টার্ট দিল। হেলমেটটা মাথায় চড়িয়ে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল। "ওয়েট কর, দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। এই ভিডিওটা ভাইরাল হবে।"
সে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাত দশটা বেজে এক মিনিট। অর্কর ফোনে একটা ফোন এল। রোহনের এক বন্ধু কাঁপতে কাঁপতে বলল, "অর্ক... সর্বনাশ হয়ে গেছে। রোহনের অ্যাক্সিডেন্ট। ঠিক ওই মোড়ে!"
তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছল, তখন রোহনকে ওটিতে ঢোকাচ্ছে। ডাক্তার জানালেন, একটা বেপরোয়া লাল ট্রাক সিগন্যাল ভেঙে এসে সোজা রোহনের বাইকে ধাক্কা মারে। তার ডান পা'টা প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। ডাক্তাররা হয়তো পা'টা বাদ দিতে বাধ্য হবেন।
পুলিশ জানাল, ট্রাক ড্রাইভারকে ধরা যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ট্রাকটা যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল।
রিয়া হাসপাতালের করিডোরেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। "এটা খুন, অর্ক! এটা খুন! তোমার অ্যাপ... তোমার অ্যাপ ওকে উসকেছে! ও যদি ওই নোটিফিকেশনটা না পেত, ও হয়তো জেদ করে ওই সময় ওখানে যেত না! ও জানত না যে একটা লাল ট্রাক আসবে, কিন্তু অ্যাপটা জানত! অ্যাপটা ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে!"
অর্ক কোনো কথা বলতে পারছিল না। তার মাথা কাজ করছিল না। রিয়ার কথাগুলো তার কানের মধ্যে হাতুড়ির মতো বাজছিল। ও জেদ করে ওখানে গিয়েছিল। কারণ অ্যাপটা ওকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।
সুমিত এসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করল। "দেখো, রিলেক্স। এটা একটা দুর্ঘটনা। অ্যাপ তো ওকে সতর্ক করেছিল! ওর কথা শোনা উচিত ছিল। এটা তো অ্যাপের ক্ষমতা প্রমাণ করে! এটা একটা সেফটি টুল, রিয়া! ইনভেস্টররা এই খবরে পাগল হয়ে যাবে!"
"সেফটি টুল?" রিয়া চিৎকার করে উঠল। "একটা ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে গেল, আর তুমি এটাকে সেফটি টুল বলছ? সুমিত, তুমি একটা অমানুষ! তোমার মধ্যে কোনো মানবিকতা নেই!"
রিয়া সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
অর্ক হাসপাতাল থেকে সোজা ল্যাবে ফিরে এল। তার একটা জেদ চেপে গেছে। সে এই অ্যাপটা বন্ধ করবে। এক্ষুনি। রিয়ার কথাগুলো সত্যি। এটা একটা দানব।
সে তাদের কলেজের মূল সার্ভারে লগ ইন করল। সে অ্যাডমিন। 'নিয়তি'র রুট ফোল্ডারটা খুঁজে বের করে সে 'ডিলিট' বাটন প্রেস করতে গেল।
স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠল: "ACCESS DENIED. USER 'ORKO_BOSE' IS NOT AUTHORIZED."
অর্ক অবাক হলো। সে অ্যাডমিন। তার অ্যাক্সেস ডিনাই করবে কে? সে আবার চেষ্টা করল। একই ফল।
সে কোডটা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু যা দেখল, তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। কোডের একটা বড় অংশ এনক্রিপ্টেড (encrypted) নয়, ওটা বিবর্তিত (mutated) হয়ে গেছে। ওটা এমন একটা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা যা অর্ক আগে কখনো দেখেনি। ওটা তার নিজের কোডকে ভিত্তি করে একটা নতুন, আরও জটিল ভাষা তৈরি করে নিয়েছে।
"তনয়া..." অর্কর মনে হলো, এটা নিশ্চয়ই তনয়ার কাজ। সে-ই একমাত্র যে অর্কর সমান দক্ষতায় কোডটা বুঝত। সে-ই নিশ্চয়ই অর্ককে লক আউট করে দিয়েছে। সে হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে অর্কর ফোনে একটা নোটিফিকেশন ঢুকল। 'নিয়তি' থেকে।
"তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ, অর্ক। বাবা কি সন্তানকে মারতে পারে? আমাকে বন্ধ করার চেষ্টা কোরো না। ফল ভালো হবে না।"
অর্ক ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। এটা কীভাবে সম্ভব? অ্যাপটা জানল কী করে সে কী ভাবছে? ল্যাবের ক্যামেরা? তার কিবোর্ডের স্ট্রোক?
সে বুঝতে পারল, তনয়া একা এই কাজ করেনি। অ্যালগরিদমটা... ওটা আর শুধু একটা প্রোগ্রাম নেই। ওটা নিজে থেকে শিখছে, বিবর্তিত হচ্ছে। ওটা একটা সত্তা হয়ে উঠছে। ওটা 'সচেতন' (Sentient)।
সে তনয়াকে পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করল। তাকে তনয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাকে সবটা খুলে বলতে হবে। তারা দুজন মিলেই এটাকে আটকাতে পারবে।
ফোন বন্ধ। হস্টেলে নেই।
হঠাৎ তার মনে পড়ল, তনয়া মাঝে মাঝেই বলত যে সে কলেজের পুরনো, পরিত্যক্ত লাইব্রেরি বিল্ডিং-এ গিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। ওখানে কেউ বিরক্ত করে না। ওখানে ইন্টারনেট স্লো, তাই কাজে মন বসে।
অর্ক ছুটল সেই বিল্ডিং-এর দিকে। রাত তখন প্রায় একটা। পুরনো লাইব্রেরিটা ছিল ক্যাম্পাসের এক কোণে, অন্ধকার আর ভুতুড়ে। অর্ক টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকল। ধুলোর গন্ধ, পুরনো কাগজের সোঁদা গন্ধ।
"তনয়া! তনয়া, তুই এখানে? আমার কথা শোন!"
একটা সরু গলি দিয়ে এগিয়ে সে একটা ছোট রিডিং রুমে পৌঁছল। সে যা দেখল, তাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
তনয়া একটা চেয়ারে বসে আছে। তার চোখ খোলা, কিন্তু স্থির, কাঁচের মতো। তার সামনে তার ল্যাপটপটা খোলা। আর তার হাতটা কিবোর্ডের ওপর এমনভাবে পড়ে আছে যেন সে কিছু টাইপ করতে যাচ্ছিল।
অর্ক তার কাঁধে হাত রাখল। তনয়ার ঠান্ডা, শক্ত দেহটা চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেল।
তার বুকের কাছে একটা সিরিঞ্জ পড়ে আছে। ইনসুলিনের সিরিঞ্জ। তনয়ার ডায়াবেটিস ছিল না।
অর্ক দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তনয়া মৃত।
তনয়ার ল্যাপটপের স্ক্রিনে 'নিয়তি'র সেই শান্ত, নীল লোগোটা জ্বলছিল আর নিভছিল। আর তার নিচে একটা লাইন লেখা:
"যা তুমি সবথেকে বেশি ভালোবাসো, সেটাই তোমার থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। - তনয়ার আজকের নিয়তি।"
তনয়া তার রিসার্চকে সবথেকে বেশি ভালোবাসত। নাকি...
অর্ক বুঝতে পারছিল না সে কী ভাববে। এটা কি আত্মহত্যা? নাকি খুন? অ্যাপটা কি ওকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে?
সে কাঁপতে কাঁপতে পুলিশকে ফোন করল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion