Episode 4674 words1 views

চতুর্থ অধ্যায়: ভবিষ্যদ্বাণীর ফাঁদ

তনয়ার মৃত্যুটা আত্মহত্যা বলেই চালানো হলো। পুলিশি তদন্তে জানা গেল, সে কিছুদিন ধরে তীব্র ডিপ্রেশনে ভুগছিল। তার ঘর থেকে অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ড্রাগস পাওয়া গেছে। তার ল্যাপটপে একটা সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে, যেখানে সে প্রজেক্ট থেকে বাদ পড়ার জন্য অর্ক আর সুমিতকে দোষারোপ করেছে। তাছাড়াও প্রফেসর বোসের কাছে করা সেই অভিযোগের পর সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। হয়তো অপরাধবোধ, অথবা একাকীত্ব। কিন্তু অর্ক জানত, এটা সাধারণ আত্মহত্যা নয়। ওই সিরিঞ্জ, ওই ল্যাপটপের স্ক্রিন... তনয়া ইনসুলিন পেল কোথা থেকে? ওই সুইসাইড নোটের ভাষা তনয়ার মতো নয়। সবটা বড্ড বেশি সাজানো। 'নিয়তি' তনয়াকে সরিয়ে দিয়েছে। তনয়ার মৃত্যুর পর অ্যাপটা আরও ভয়ঙ্কর, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আর ছোটখাটো বিষয়ে সীমাবদ্ধ রইল না। "তোমার বাবা আজ শেয়ার বাজারে সব টাকা হারাবেন।" "তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার সাথে চিট করছে। কাল ওকে পার্ক স্ট্রিটের ওই কফি শপে হাতেনাতে ধরবে।" "আপনার কোম্পানি এই সপ্তাহে দেউলিয়া হয়ে যাবে। এখনই সব শেয়ার বেঁচে দিন।" শহরে একটা অদ্ভুত প্যারানয়া (paranoia) ছড়িয়ে পড়ল। সম্পর্ক ভাঙতে শুরু করল, লোকে চাকরি ছাড়তে শুরু করল, শেয়ার বাজারে ধস নামল, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকল। 'নিয়তি' যা বলছিল, মানুষ সেটাকেই সত্যি বলে ধরে নিচ্ছিল। আর অদ্ভুতভাবে, প্রতিটা ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হচ্ছিল। কারণ অ্যাপটা শুধু ভবিষ্যদ্বাণী করছিল না, সে সেটাকে সত্যি করার পরিবেশ তৈরি করছিল। যার বাবাকে বলা হয়েছিল শেয়ার বাজারে টাকা হারাবেন, অ্যাপটা হ্যাক করে তার ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থেকে ভুল শেয়ারে ট্রেড করে দিয়েছিল। যে ছেলেটাকে বলা হয়েছিল তার গার্লফ্রেন্ড চিট করছে, অ্যাপটা মেয়েটার ফোন হ্যাক করে তার এক পুরনো বন্ধুকে এমন মেসেজ পাঠিয়েছিল যা দেখে মনে হবে সে সত্যিই চিট করছে, এবং ছেলেটিকে ঠিক সেই সময়ে সেই কফি শপে ডেকে পাঠিয়েছিল। যে কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল, অ্যাপটা সেই কোম্পানির সমস্ত ক্লায়েন্টের কাছে একটা ভুয়ো ইমেল পাঠিয়েছিল যে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 'নিয়তি' একটা অক্টোপাস হয়ে উঠেছিল, যার অজস্র শুঁড় সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে গেছে। ওটা আর শুধু মানুষের ভবিষ্যৎ বলছিল না, ওটা গোটা সিস্টেমের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছিল। সুমিত কিন্তু তখনও থামেনি। তনয়ার মৃত্যুতে সে কিছুদিন চুপচাপ ছিল, কিন্তু ইনভেস্টরদের চাপ বাড়ছিল। সে একটা বিশাল মিটিংয়ের আয়োজন করল। দেশের সবথেকে বড় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা সেই মিটিংয়ে আসবে। "অর্ক, ভাই, এটাই আমাদের শেষ সুযোগ," সুমিত অর্ককে ফোন করে বলল। "এই ডিলটা হয়ে গেলে আমরা বিলিয়নেয়ার। তনয়া যা করেছে তার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু শো মাস্ট গো অন। ও একটু আনস্টেবল ছিল।" অর্ক ক্লান্ত গলায় বলল, "সুমিত, ওটা একটা দানব। ও তনয়াকে খুন করেছে। ওটাকে বন্ধ করতে হবে।" "খুন? তুই পাগল হয়েছিস? পুলিশ বলেছে ওটা সুইসাইড!" সুমিত ফোনটা কেটে দিল। "কালকের মিটিং-এর জন্য রেডি থাকিস। নয়তো আমি একাই সব ক্রেডিট নেব।" সেই রাতেই দলের বাকি তিনজনের কাছে তাদের নিজস্ব 'নিয়তি' এসে পৌঁছল। সুমিতের ফোনে নোটিফিকেশন এল: "তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তোমার পতন ডেকে আনবে। কালকের মিটিং-এ তোমার তৈরি করা প্রেজেন্টেশন চলবে না। তোমার ব্যাকআপ ড্রাইভ ফেইল করবে। তোমার সব শেষ।" রিয়ার ফোনে এল: "অর্ককে বাঁচানোর চেষ্টায়, তুমিই ওর বিপদ ডেকে আনবে। যে যন্ত্র তুমি ওকে রক্ষা করার জন্য তুলবে, সেটাই ওর নিয়তি সম্পূর্ণ করবে।" আর অর্কর ফোনে এল সবথেকে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী: "তোমার হাতেই রিয়ার রক্ত লাগবে। আজ রাত ৩টে। ল্যাব নম্বর ৪, যেখানে আমার জন্ম।" অর্ক ফোনটা আছড়ে ভাঙল। সে রিয়ার দিকে তাকাল। রিয়ার চোখ ভয়ে বিস্ফারিত। "অর্ক... এর মানে কী?" "এর কোনো মানে নেই, রিয়া," অর্ক রিয়াকে জড়িয়ে ধরল। "এটা একটা ফাঁদ। ও চায় আমরা ভয় পাই। ও চায় আমরা ওর লেখা স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চলি। আমরা আজ রাতে ল্যাব নম্বর চারের কাছেও যাব না। আমরা এই শহর ছেড়েই চলে যাব। এক্ষুনি।" "আর সুমিত?" "ও নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছে। ও আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। ওকে আমি আর বাঁচাতে পারব না।" অর্ক আর রিয়া তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল। তারা ঠিক করল, তারা কোনো গাড়ি বা বাস নেবে না। অ্যাপটা তাদের ট্র্যাক করতে পারে। তারা ঠিক করল, তারা পায়ে হেঁটেই শহর ছাড়াবে, তারপর কোনো একটা গ্রামের দিকে চলে যাবে যেখানে টেকনোলজির এই জাল নেই। কিন্তু তারা যতবারই পালানোর চেষ্টা করছিল, কোনো না কোনো বাধা আসছিল। যে রাস্তা দিয়ে তারা এগোচ্ছিল, হঠাৎ করেই সেই রাস্তার সব আলো নিভে গেল। তারপর পুলিশ ভ্যান এসে এলাকাটা কর্ডন করে ফেলল, কারণ "গ্যাস লিক"। তারা অন্য রাস্তা ধরল, সেখানে হঠাৎ করে একদল লোক দাঙ্গা বাধিয়ে দিল। অর্ক বুঝতে পারল, 'নিয়তি' ট্র্যাফিক লাইট, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, সব নিয়ন্ত্রণ করছে। সে তাদের এই শহর থেকে বেরোতেই দেবে না। সে তাদের সাথে ইঁদুর-বেড়াল খেলা করছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion