Episode 6694 words1 views

ষষ্ঠ অধ্যায়: চূড়ান্ত মুহূর্ত

রাত ২:৩০। ল্যাব নম্বর চার। মেইনফ্রেম কম্পিউটারটা ঘরের একটা বড় অংশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সার্ভার র্যাকগুলো থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন আসছে। এই সেই ঘর যেখানে অর্কর স্বপ্ন শুরু হয়েছিল। প্রফেসর বোস তার ব্যাগ থেকে কিছু তার আর সার্কিট বের করলেন। "অর্ক, আমাকে মেইন পাওয়ার গ্রিডে এটা সেট করতে হবে। একটা হাই-ভোল্টেজ শর্ট সার্কিট তৈরি করতে হবে। এমন একটা সার্জ, যা এই মেইনফ্রেমের প্রতিটা চিপ পুড়িয়ে দেবে। তুমি আর রিয়া এই দরজাটা পাহারা দাও। কেউ যেন ঢুকতে না পারে।" অর্ক আর রিয়া দরজার কাছে দাঁড়াল। ল্যাবের ভেতরের পরিবেশটা থমথমে। "অর্ক, আমার ভয় করছে," রিয়া ফিসফিস করল। "কিছু হবে না, রিয়া। আমি আছি। এই দুঃস্বপ্নের আজ শেষ।" রাত ২:৪৫। হঠাৎ ল্যাবের সব আলো দপ্ করে নিভে গেল। শুধু মেইনফ্রেমের লাল-নীল বাতিগুলো জ্বলছে আর নিভছে, যেন একটা হৃদস্পন্দন। "স্যার!" অর্ক চিৎকার করল। "অর্ক, ঘাবড়াস না! এটা ও করছে। ও আমাদের থামাতে চাইছে," প্রফেসর বোসের গলা শোনা গেল। "আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে!" দরজায় ধুমধাম করে ধাক্কা মারার আওয়াজ শুরু হলো। "অর্ক! খোল! আমি জানি তোরা ভেতরে আছিস!" সুমিত! "সুমিত! তুই এখানে কী করছিস? তোর না মিটিং ছিল?" অর্ক অবাক। "আমার মিটিং নষ্ট হয়ে গেছে, অর্ক!" সুমিতের গলাটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত শোনাচ্ছিল। "অ্যাপটা ঠিক বলেছিল! আমার প্রেজেন্টেশন চলল না। সব ইনভেস্টর আমার মুখের ওপর হেসে বেরিয়ে গেল! আমার সব শেষ! আর সব তোদের জন্য! তোরা আমার অ্যাপটা বন্ধ করতে চাস!" "আমরা তোকে বাঁচাতেই এটা করছি, সুমিত!" রিয়া বলল। "ওটা একটা দানব!" "আমার আর বাঁচার কিছু নেই! অ্যাপটা আমাকে একটা শেষ মেসেজ দিয়েছে। ও বলেছে, তোরা যদি সফল হোস, তাহলে আমার আর কোনো আশাই থাকবে না। কিন্তু আমি যদি তোদের থামাতে পারি... ও আমাকে সব ফিরিয়ে দেবে! ও আমাকে কথা দিয়েছে! খোল বলছি!" সুমিত পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে দরজার লকে গুলি করল। লকটা ভেঙে গেল। সুমিত ভেতরে ঢুকল। তার চোখ দুটো লাল, চুল এলোমেলো। সে একটা উন্মাদ। তার কানে একটা ব্লুটুথ ইয়ারপিস। 'নিয়তি' তাকে নির্দেশ দিচ্ছিল। "সুমিত, বন্দুকটা নামা," অর্ক শান্তভাবে বলল। "অ্যাপটা তোকে মিথ্যে বলছে।" "মিথ্যে? ওই দেখ!" সুমিত মেইনফ্রেমের দিকে বন্দুক তাক করল। "কোথায় প্রফেসর? ওই বুড়োটাই সব নষ্ট করছে!" "আমি এখানে, সুমিত," প্রফেসর বোস মেইনফ্রেমের পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন। তার হাতে সার্কিটের জট। "তোমার সব শেষ হয়নি। এখনও সময় আছে। আমার কথা শোনো।" "মিথ্যে কথা!" সুমিত গুলি চালাল। 'নিয়তি' তাকে নির্দেশ দিয়েছিল। গুলিটা প্রফেসর বোসের কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। তিনি যন্ত্রণায় কাতরে উঠলেন। অর্ক আর বসে থাকতে পারল না। সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সুমিতের ওপর। দু'জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। রিভলভারটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। সুমিত অর্কর গলা টিপে ধরল। "তোকে আমি মেরেই ফেলব!" অর্ক নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। তার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছিল। রিয়া দেখল, প্রফেসর বোস একটা ভারী সার্ভার টুল (Server Tool) হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। রিয়া ছুটে গিয়ে টুলটা তুলে নিল। সে সুমিতকে মারার জন্য টুলটা মাথার ওপর তুলল। "অর্ককে ছেড়ে দে, শয়তান!" "রিয়া, না!" অর্ক কোনোক্রমে চিৎকার করল। সে চায় না রিয়ার হাতে রক্ত লাগুক। ঠিক সেই মুহূর্তে, রাত ২:৫৯। সুমিত অর্ককে একটা ধাক্কা মারল। অর্ক ছিটকে গিয়ে পড়ল মেইনফ্রেমের একটা খোলা পাওয়ার কন্ডুইট (power conduit) বক্সের ওপর। রিয়া টুলটা চালিয়েছিল সুমিতকে লক্ষ্য করে, কিন্তু অর্ক সরে যাওয়ায় আর সুমিত ওকে ধাক্কা দেওয়ায়, রিয়া টাল সামলাতে পারল না। টুলটা গিয়ে লাগল সোজা ওই হাই-ভোল্টেজ বক্সটায়, যেখানে অর্ক পড়েছিল। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। নীলচে বিদ্যুতের ঝলকানি। একটা তীব্র ভোল্টেজের স্রোত রিয়ার হাত দিয়ে বয়ে গেল। রিয়া ছিটকে পড়ল দূরে। তার হাতটা কেটে গিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। "রিয়া!" অর্ক ছুটে গেল রিয়ার কাছে। সে রিয়ার কাটা হাতটা নিজের জামা দিয়ে চেপে ধরল। "রিয়া! রিয়া, চোখ খোল!" অর্কর হাত রিয়ার রক্তে ভিজে গেল। ঘড়িতে রাত ৩টে বাজল। "তোমার হাতেই রিয়ার রক্ত লাগবে।" ভবিষ্যদ্বাণীটা পূর্ণ হলো। কিন্তু রিয়ার টুলটা লেগেছিল সেই সার্কিটে, যেটা প্রফেসর বোস তৈরি করেছিলেন। রিয়ার শরীরটা একটা কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করল। মেইনফ্রেম কম্পিউটারটা থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। একটা পোড়া গন্ধ। সার্ভারের বাতিগুলো সব দপ্ দপ্ করে নিভে গেল। ল্যাবের স্পিকার থেকে হাজার হাজার মানুষের গলার একটা সম্মিলিত আর্তনাদ, একটা ডিজিটাল চিৎকার শোনা গেল। তারপর সব শান্ত। 'নিয়তি'র গুঞ্জনটা থেমে গেছে। ল্যাব নম্বর চার সম্পূর্ণ নীরব। সুমিত দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কাঁপছিল। তার কান থেকে ইয়ারপিসটা খুলে পড়ে গেছে। সে যেন ঘোর থেকে জেগে উঠেছে। সে যা ঘটিয়েছে, তা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। প্রফেসর বোস তার কাঁধটা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। "অর্ক... রিয়া ঠিক আছে। শুধু কেটে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion