ঘটনাগুলো ক্রমশ বাড়তে লাগল, তাদের জীবনকে এক দুঃস্বপ্নে পরিণত করছিল। তারা দিনের বেলায়ও বাড়ির মধ্যে এক চাপা আতঙ্ক অনুভব করত। রান্নাঘরের থালাবাসন হঠাৎ করে পড়ে যেত, শোবার ঘরের আলমারির দরজা নিজে থেকেই খুলে যেত, আর কখনো কখনো মনে হতো যেন কেউ তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, অথচ কেউ থাকত না, শুধু এক শীতল বাতাস তাদের গা ছুঁয়ে যেত, যা তাদের শরীরকে হিমশীতল করে দিত। দেয়াল থেকে যেন এক অদৃশ্য হাত বেরিয়ে এসে তাদের স্পর্শ করত, যা তাদের শরীরকে হিমশীতল করে দিত, আর তাদের মনে হতো যেন তাদের রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। রাতের বেলা, তারা প্রায়ই শুনতে পেত চিলেকোঠার দিক থেকে পায়ের শব্দ, যেন কেউ ভারী পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর সেই শব্দ ক্রমশ তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসত।
একদিন সকালে, অর্ক দেখল তার লেখার টেবিলের উপর একটা পুরনো ডায়েরি পড়ে আছে। ডায়েরিটা অনির্বাণের ছিল। ডায়েরির মলাটটা ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা ছিল, যেন অনেক বছর ধরে কেউ সেটা স্পর্শ করেনি, আর তার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছিল, তাতে রক্তের শুকনো দাগ লেগেছিল, যা দেখে গা শিউরে উঠল। অর্ক ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় অনির্বাণের কষ্ট, রাধার প্রতি তার ভালোবাসা, তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের বর্ণনা, আর তার মৃত্যুর আগের মুহূর্তের বর্ণনা ছিল। অনির্বাণ লিখেছিল, কীভাবে সে রাধার জন্য ছটফট করত, কীভাবে তার বাবা তাদের ভালোবাসাকে পদদলিত করেছিল, আর কীভাবে সে মুক্তির জন্য মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিল। ডায়েরিটা পড়তে পড়তে অর্কের চোখে জল এসে গেল, তার শরীর কাঁপতে শুরু করল, তার মনে হয়েছিল যেন সে অনির্বাণের কষ্ট অনুভব করতে পারছে। সে বুঝতে পারল, এই বাড়িতে সত্যিই কিছু একটা আছে, আর সেটা শুধু নিছকই কোনো কল্পনা নয়, বরং এক গভীর ট্র্যাজেডির ফল, যা আজও এই বাড়ির বাতাসে মিশে আছে, এক চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতো।
অর্ক মিতালীকে ডায়েরিটা দেখাল। মিতালীও ডায়েরিটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। অনির্বাণ আর রাধার করুণ পরিণতি তাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল, তাদের চোখে জল এসে গেল, তাদের হৃদয় যেন ভেঙে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পারল, অনির্বাণ আর রাধার আত্মা এই বাড়িতে আটকে আছে। তাদের শান্তি নেই, কারণ তাদের প্রতি নির্মম অন্যায় করা হয়েছিল। তাদের আত্মা মুক্তির পথ খুঁজছে, আর হয়তো তাদের কাছেই সাহায্য চাইছে, যাতে তারা শান্তি পায়, আর তাদের কষ্ট দূর হয়। অর্ক আর মিতালী সিদ্ধান্ত নিল, তারা এই দুই অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দেবে, তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবে, যাতে তারা চিরতরে শান্তি পায়।
তারা স্থানীয় এক পুরোহিতের সাথে যোগাযোগ করল। পুরোহিত মশাই বাড়িতে এলেন, আর বাড়ির পরিবেশ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে সত্যিই অশুভ শক্তি আছে, যা দীর্ঘকাল ধরে এই বাড়িতে বসবাস করছে এবং তাদের ক্ষতি করতে চাইছে। তিনি তাদের বললেন, অনির্বাণ আর রাধার আত্মা তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চায়, কিন্তু তারা পথভ্রষ্ট, তাদের আত্মাকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। তাদের শান্তি দেওয়ার জন্য, তাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন, আর তাদের আত্মাকে সঠিক পথে চালিত করতে হবে, যাতে তারা মুক্তি পায় এবং আর কাউকে কষ্ট না দেয়। পুরোহিত মশাই আরও বললেন যে, এই আত্মাদের মুক্তি দেওয়া সহজ হবে না, কারণ তাদের প্রতিহিংসা অনেক গভীর, আর তাদের শক্তিও অনেক বেশি।
পুরোহিত মশাইয়ের পরামর্শে, অর্ক আর মিতালী বাড়ির পেছনের পুকুর থেকে রাধার দেহাবশেষ খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিল। পুকুরটা ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, আর তার জল ছিল কালো আর ঘোলাটে, যেন তার গভীরে এক অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে, যা কাউকে তার কাছে যেতে দেয় না। দিনের বেলায়ও সেখানে যেতে গা ছমছম করত, মনে হতো যেন পুকুরের গভীর থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের টানছে, তাদের ডুবিয়ে দিতে চাইছে। তারা একটি ছোট নৌকা নিয়ে পুকুরের গভীরে প্রবেশ করল। জলের নিচে ছিল অসংখ্য শেওলা আর আগাছা, যা তাদের পা জড়িয়ে ধরছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, তারা পুকুরের গভীরে রাধার দেহাবশেষের কিছু অংশ খুঁজে পেল – কিছু হাড় আর তার কাপড়ের টুকরো, যা দেখে গা শিউরে উঠল, আর তাদের মনে হয়েছিল যেন রাধার আত্মা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই দৃশ্য দেখে মিতালী কেঁদে ফেলল, তার হৃদয় যেন ভেঙে গিয়েছিল, আর তার মনে হয়েছিল যেন রাধার কষ্ট সে অনুভব করতে পারছে। তারা অনির্বাণ আর রাধার জন্য একটি ছোট স্মৃতিসৌধ তৈরি করল বাড়ির বাগানে, যেখানে সূর্যের আলো এসে পড়ত, আর যেখানে তারা শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারবে। সেখানে তারা তাদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দুটি গোলাপ গাছ লাগাল, একটি সাদা আর একটি লাল, যা তাদের অমর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকবে। তারা পুরোহিতের সাহায্যে একটি শান্তি যজ্ঞের আয়োজন করল, যা তাদের আত্মাকে মুক্তি দেবে।
যজ্ঞের সময়, বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে এক অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগল। প্রথমে মৃদু, তারপর ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সেই আলো, যেন সেই আলোতে অনির্বাণ আর রাধার আত্মা একত্রিত হচ্ছে। কিন্তু সেই আলোর সাথে সাথে এক তীব্র ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল, আর বাড়ির দেয়াল থেকে যেন চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসতে লাগল, যা তাদের কানে বাজছিল। মনে হলো যেন অনির্বাণ আর রাধার আত্মা তাদের মুক্তি পেয়েছে, তাদের দীর্ঘদিনের কষ্ট শেষ হয়েছে, তারা শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর, বাড়ির পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। সেই অদ্ভুত নীরবতা আর ছিল না, বরং একটা নতুন শান্তি বিরাজ করছিল, যা তাদের মনকে শান্ত করে দিল। রনি, তাদের কুকুরটা, এবার শান্তিতে ঘুমিয়েছিল, কোনো ভয় ছাড়াই, যেন সেও অনুভব করতে পারছিল সেই শান্তি।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion